ঘৃণার উদর থেকে কেবল ঘৃণারই জন্ম হয় – জাহিদ হাসান
উর্দু একটা ভাষা। এই ভাষায় মহৎ সাহিত্য রচিত হয়েছে। এই ভাষায় আমাদের অন্তরকে নিত্য বিকশিত ও আনন্দিত করার মতো কবিতা আছে, বিষাদ ভুলিয়ে দেওয়ার মত গান আছে, ‘ঠান্ডা গোশত’র মত গা শিউরে ওঠা গল্প আছে।
কোথাও একটা মিল থাকায় উর্দু ও হিন্দি আমরা বেশ বুঝতেও পারি। যেমন, গোলাম আলীর গাওয়া বিখ্যাত সেই ‘চুপকে চুপকে রাত দিন’ গানটির কথা ধরি। এর দ্বিতীয় কলি, ‘হামকো আব তক আশেকি কা উয়ো জামানা ইয়াদ হ্যায়’ (অর্থাৎ আমাদের ভালোবাসার সেই দিনগুলোর কথা এখনও মনে পড়ে) … গানটি যে কাফি রাগে গাওয়া, এমন কোমল কথাগুলো যে লিখেছিলেন ভারতের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা হাসরাত – এসব না জেনেও যুগের পর যুগ গানটি আমাদের ভালো ভালো লেগে যাচ্ছে।
সাদত হাসান মান্টো, মির্জা গালিব কিংবা শেষ মুগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর কেউ এই ভাষায় বিদ্বেষ ছড়ান নি। বরং মানবতা আর প্রেমের জয়গান গেয়েছেন।
তেমনি কাওয়ালি হলো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। আধ্যাত্মিক প্রেম আর ভক্তির গান। নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার শিষ্য আমীর খসরু প্রবর্তিত ‘কাওয়ালি’তে একজন মূল গায়ক যখন একটা মেসেজ থ্রো করেন ও কয়েকজন সহযোগী যখন ধুয়া ধরেন তখন সেই উচ্চলয়ের পরিবেশনার ঢঙের সাথে বাঙালির নিম্নলয়ের কীর্তনের কোথাও একটা মিল পাওয়া যায়। মিল পাওয়া যায় খেয়াল নামক উচ্চাঙ্গ সংগীতের ধারাটির সাথেও। যাত্রা, জারি, সারির মতো কাওয়ালিও প্রায় হারিয়ে গেছে। কেউ একটু ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলে তাতে শংকিত হওয়ার কিছু নেই।
শিশুকালে রাত জেগে কাওয়ালদের কাছ থেকে দেখেছি। তাঁদের গান শুনেছি। এখনও সাবরি ভাইদের বা ফরিদ আয়াজ আবু মুহাম্মদের কাওয়ালি শুনি, তাতে আমার বাংলা ও বাংগালীত্বের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয় না। বরং আমি আরো উন্নত ও পরিণত হই।
মনে রাখা দরকার, ঘৃণার উদর থেকে কেবল ঘৃণারই জন্ম হয়। বহুবছর আগে বাঙালি ব্রতচারী লেখক গুরুসদয় দত্ত লিখেছিলেন “বিশ্ব-মানব হবি যদি শাশ্বত বাঙ্গালী হ” – প্রশ্ন হলো, অন্তরে ঘৃণা পুষে রেখে কি শাশ্বত বাঙালী হওয়া যাবে? উর্দুকে ঘৃণা করাটা গ্রাহ্য বলে মনে হলে অন্যরা যদি বাংলাকে ঘৃণা করে তখন কোন মুখে আপত্তি জানাবো? প্রাচুর্যে ভরা একটা নিরীহ ভাষা কেন কর্কশ রাজনীতির কারনে বৈষম্যের শিকার হবে?