`উপন্যাসের পথে’ বই থেকে
উর্দু-হিন্দি কথাসাহিতিক মুন্সী প্রেমচন্দ বলেছিলেন, ‘…পুরানো আমলে সমাজের লাগাম ছিল ধর্মের হাতে। মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সভ্যতার আধার ছিল ধর্মীয় নির্দেশ আর সে কাজ করত ভয় অথবা প্রলোভন দিয়ে। পাপ-পুণ্যের শাসন ছিল তার সাধনা। এখন সাহিত্য সেই কাজ নিজের দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছে। তার সাধনা হলো সৌন্দর্যপ্রীতি। সে মানুষের মধ্যে সৌন্দর্যপ্রীতি জাগানোর চেষ্টা করে। এমন কোনো মানুষ নেই যার মধ্যে সৌন্দর্যের অনুভূতি নেই। সাহিত্যিকের মধ্যে এই বৃত্তি যতটা জাগ্রত ও ক্রিয়াশীল হয় তার রচনা ততটাই প্রভাবশালী হয়। প্রকৃতি-নিরীক্ষণ আর নিজের অনুভূতির তীক্ষ্ণতার বদৌলতে তার সৌন্দর্যবোধে এত তীব্রতা আসে যে, যা কিছু অসুন্দর, অভব্য, মনুষ্যত্বরহিত, সেসব তার জন্য অসহ্য হয়ে ওঠে। তার উপর সে শব্দ ও ভাবের সমস্ত শক্তি দিয়ে আক্রমণ করে।…নিঃসন্দেহে শিল্পের উদ্দেশ্য সৌন্দর্যবোধের পুষ্টিসাধন এবং তা আমাদের আধ্যাত্মিক আনন্দের উপায়।’
…উপন্যাস লেখা তো আর ইট ভাঙার কাজ নয় যে ইচ্ছে হলো আর অমনি একটা হাতুড়ি নিয়ে বসে পড়লে। সকালে ভাঙা শুরু করলে আর বিকেল নাগাদ কয়েক মণ ভেঙে ফেললে। উপন্যাস মাটি কাটার কাজও নয় যে একটা কোদাল নিয়ে কাটতে শুরু করে দিলে। উপন্যাস ওহি নয় যে তোমার কাছে নাযেল হবে, ইলহামও নয় যে স্বপ্নের মতো হুট করে মনে আসবে আর হুট করেই লিখে ফেলবে। উপন্যাস লেখার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতির।
কী সেই প্রস্তুতি? প্রথমে তুমি নিজের মুখোমুখি হও। অনুভাব করার চেষ্টা করো ফুলের গন্ধে তুমি বিমোহিত হও কিনা? প্রেমিকার চোখ তোমাকে বিস্ময়াভিভূত করে কিনা? শিশুর মুখ দেখে তোমার ভেতর পবিত্র-ভাব উদয় হয় কিনা? মানবতার অপমান তোমাকে বেদনাবোধে তাড়িত করে কিনা? প্রাণীহত্যায় তুমি কষ্ট পাও কিনা? সমাজের ক্ষত তোমাকে কষ্ট দেয় কিনা? ধর্মান্ধতা, ধর্মব্যবসা, অধর্মের প্রতিষ্ঠা, সমাজের অন্যায়-অবিচার তোমাকে ক্ষুব্ধ করে কিনা? সমুদ্রের অপার সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় বোধ করো কিনা? পাহাড়ের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে বিহ্বল বোধ করো কিনা? কর্মব্যস্ত দিনের অন্তরালে কোনো হাহাকার শুনতে পাও কিনা? মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তার অন্তরের কথা টের পাও কিনা? জরা ও মৃত্যুকবলিত মানুষের আর্তনাদ শুনতে পাও কিনা? রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে মহাবিশ্বের বিলাপ শুনতে পাও কিনা? কান পেতে শোনো, তোমার বুকের খাঁচায় বসে কেউ মুরলিতে বিরহের সুর তুলেছে কিনা? জীবনকে তুমি আঙুলের ডগায় নিয়ে লাটিমের মতো ঘোরাতে পারো কিনা? পৃথিবীর সমস্ত অর্থ-বিত্ত তোমার কাছে অর্থহীন মনে হয় কিনা? তোমার মধ্যে এক ঋষি বাস করে কিনা, জগতের সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে যে নিজের সাধনায় নত, স্বর্গের মোহময়ী অপ্সরীও যার ধ্যান ভাঙাতে পারে না?
উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে তোমাকে স্বাগতম হে বাল্মিকী-বেদব্যাসের উত্তরাধীকারী। তোমাকে স্বাগতম হে হোমার-ফেরদৌসী-দান্তের উত্তরাধিকারী। তোমাকে স্বাগতম হে তলস্তয়-দস্তয়ভস্কির উত্তরাধিকারী। তোমাকে স্বাগতম হে স্তাঁদাল-জোলা-লরেন্সের উত্তরাধীকারী। তোমাকে স্বাগতম হে বঙ্কিম-রবীন্দ্র-বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিকের উত্তরাধীকারী। তোমাকে স্বাগতম হে হুগো-ফকনার-হেমিংওয়ের উত্তরাধিকারী। তোমাকে স্বাগতম হে কামু-কাফকা-মার্কেসের উত্তরাধিকারী। তুমি চোখ বন্ধ করো। নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে তৃতীয় চক্ষুর উন্মীলন ঘটাও। অবাক বিস্ময়ে দেখো, তোমার মাথায় জগদ্বিখ্যাত মহান ঔপন্যাসিকরা তাঁদের সম্মিলিত হাত স্থাপন করে আছেন।
তারপর চোখ খোলো। শুরু করো পাঠ। যত পড়বে তত জ্ঞানী হবে। তুমি কিন্তু মায়ের পেট থেকে জ্ঞানী হয়ে জন্মাওনি। কোনো মানুষই জন্মায় না। যে শিশুটি আজ জন্ম নিল, একটি ছাগলছানা ও তার মধ্যে দৈহিক ফারাক ছাড়া আর কোনো ফারাক নেই। আছে কি? আমি নিশ্চিত নই। হয়ত থাকতে পারে। হয়ত মানুষ প্রকৃতিগতভাবে ছাগলছানার চেয়ে আলাদা, প্রকৃতিগতভাবেই সে মানবীয় বোধ নিয়ে জন্মায়।
তাই-বা কী করে বলি? যদি তাই হতো, অবুঝ শিশুটি নিজের মল নিজের মুখে নেয় কেন? ধুলো-কালি মুখে মাখে কেন? আগুন দেখলে হাত দিতে চায় কেন? জল দেখলে ঝাপ দিতে চায় কেন? তার মানে ফারাক আসলেই নেই। না থাকলে ছাগলছানাটি থেকে নিজেকে সে আলাদা করে কীভাবে? আলাদা তাকে হতে হবে, সে ছাগলছানাটি নয়, এই বোধ তার মধ্যে জন্মায় কেমন করে? প্রথমত তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে। তার বাবা-মা ছাগলছানাটির মতো নয়, আলাদা। তাদের কথা আলাদা, চাল-চলন, আচার-আচরণ আলাদা, চিন্তা-চেতনা, খাদ্যাভাস আলাদা। বাবা-মাকে দেখে কিংবা প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন বা সমাজের আর আর মানুষগুলোকে দেখে সেও ছাগলছানা থেকে নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার চেষ্টা করে। সবাই তাকে আলাদা হতে সহযোগিতা করে। একটা পর্যায়ে সে সফল হয়। অর্থাৎ সে আলাদা হয়ে ওঠে পরিবার ও সমাজের সহযোগিতায়।
কিন্তু তার পরিবার বা সমাজ, জ্ঞানী যাকে বলা হয়, তা তো নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার জ্ঞানী হয়ে ওঠার উপায় কী? কীভাবে সে জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারবে? উপায় একটিই, প্রকৃতির গভীর পাঠ। প্রকৃতি বলতে শুধু গাছ-বৃক্ষ, ফুল-পাখি, নদী-সমুদ্র, আকাশ-মাটি নয়, প্রকৃতির মধ্যে মানুষও অন্তর্ভুক্ত। সব কিছু মিলিয়েই প্রকৃতি। কিন্তু প্রকৃতির সেই পাঠ কোন উপায়ে হবে? চোখের দেখা আর অন্তরে ধারণের মধ্য দিয়ে? হ্যাঁ, এটা একটা উপায় হতে পারে। কিন্তু সে তো শুধু বর্তমানকে দেখছে। অতীতের প্রকৃতি, অতীতের বিশ্বজগত, অতীতের মানুষ তো তার দেখা নেই। এটা তার অভিজ্ঞতার বাইরে। শুধু বর্তমানকে দেখে, বুঝে বা ধারণ করে যে জ্ঞান সে অর্জন করবে, তা তো খণ্ডিত জ্ঞান, পরিপূর্ণ নয়।
পরিপূর্ণ জ্ঞানী হয়ে ওঠার উপায় কী? কোন মাধ্যমকে অবলম্বন করে সে জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারবে? মাধ্যম একটাই, বই। তার পূর্বপুরুষরা বইয়ের মাধ্যমে যে অতীতকে ধরে রেখে গেছে, তা পাঠের মাধ্যমে সে জানতে পারবে অতীত সম্পর্কে। সেই বই হতে পারে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ কিংবা ইতিহাসের।
`উপন্যাসের পথে’ বই থেকে
স্বকৃত নোমান
পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিতব্য।
প্রচ্ছদ : আনিসুজ্জামান সোহেল
Bizu S.I. Shahidul Islam Bizu