আমেরিকায় আজ হ্যাপি হ্যালোইন উৎসব! – বেনজির শিকদার
আজ ছিল হ্যাপি হ্যালোইন (Happy Halloween) অর্থাৎ ভূত সেজেই ভূত তাড়ানোর উৎসব!
প্রতিবছর অক্টোবর মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ তারিখ মৃত আত্মাদের স্মরণে এ দিবসটি উদযাপিত হয়।
কিন্তু কেন এই হ্যালোইন দিবস কিংবা এর উৎপত্তিইবা কোথা থেকে?
আমেরিকানরা মনে করেন “ধর্ম যার যার উৎসব সবার”! প্রতিবারের মতো এবারও এক সপ্তাহ আগে হতেই মেয়ের বায়না ছিল হ্যালোইনের দিনে তাকে নিয়ে ক্যান্ডি কুড়াতে যেতে হবে। স্কুল হতে ফেরার পর বিকেলবেলা বের হলাম।
পুরো রাস্তা জুড়ে বিভিন্ন রঙবেরঙের ভূতুড়ে পোশাকে সজ্জিত বাচ্চাসহ অনেকেই। সবার হাতেই ক্যান্ডির ব্যাগ বা কমলা রঙের ঝুড়ি। জ্যান্ত ভূতেদের ট্রিট দিতে পুরো শহরই যেন অস্থির।
চোখে পড়লো স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ প্রতিটা বাড়িই সাজানো হয়েছে, মাকড়শার জাল, কঙ্কাল, মাথার খুলি কিংবা বিভিন্ন ভুতুড়ে টাইপের মুখোশ দ্বারা ভয়ংকর ভৌতিক ডেকোরেশনে!
কোথাও কোথাও দেখা মিললো ঘোড়ার গাড়ির। সিটি কর্তৃপক্ষের পারমিশন নিয়ে বিভিন্ন রাস্তা ব্লক করে বাচ্চাদের আনন্দ দেবার জন্যই এ ব্যবস্থা। ফি ছাড়া লাইন মেইনটেইন করে যে কেউ চাইলেই ৮/১০ মিনিটের জন্য এ গাড়িতে চড়ে ঘুরে আসতে পারে শহরের কিছু অংশ।
হ্যালোইনের প্রস্তুতির অপরিহার্য অংশ হলো মিষ্টি কুমড়া। ছুরি দিয়ে মিষ্টি কুমড়ার শরীর কেটে মুখের আকৃতির ছোট গর্ত করে, ভেতরে বাতি জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় প্রতীকী দৈত্য, জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন। এরপর ওই সকল দৈত্যাকৃতি মিষ্টি কুমড়া স্থাপন করা হয় বাড়ির উঠোন কিংবা প্রবেশদ্বারে।
ট্রিট নিতে চাইলে বাচ্চাদের ভৌতিক উঠোন পেরিয়েই ভেতরে যেতে হয়। আমেরিকায় এই একটি মাত্র দিন, যেদিন বিনা দ্বিধায় যে কারো বাড়ির আঙ্গিনায় যাওয়া যায় আর অনায়াসে বাড়ির কলিংবেল কিংবা কড়া খটখটালেও কেউ আপত্তি জানায় না।
মূলত ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দের খ্রিস্টীয় ধর্ম থেকে ‘হ্যালোইন’ বা ‘হ্যালোউইন’ শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ ‘শোধিত সন্ধ্যা বা পবিত্র সন্ধ্যা’। শব্দটি স্কটিশ ভাষার শব্দ ‘অল হ্যালোজ ইভ’ (All Hallows Eve) থেকে এসেছ। দিনে দিনে এটি পরিবর্তিত হয়ে ‘হ্যালোজ’ ইভ’ শব্দটি ‘হ্যালোইন’-এ রূপান্তরিত হয়।
প্রায় দুই হাজার বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করতো কেল্টিক জাতি। নভেম্বরের প্রথম দিনটি তারা নববর্ষ বা ‘সাহ-উইন’ হিসাবে পালন করতো। এই দিনটিকে গ্রীষ্মের শেষ এবং শীতের শুরু বলে ধরে নিতো। তাদের ধারণা ছিল, অক্টোবরের শেষের দিবাগত রাতটি সবচেয়ে খারাপ রাত, তারা বিশ্বাস করতো অক্টোবরের ৩১ তারিখ মৃতের দেবতা “সামান” এর আহবানে সকল প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে। ওইদিন উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোইন ডাইনি সারা আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ায়।
কখনওবা সবুজ লিকলিকে দেহের ডাইনি বুড়িটা করা নারে কোনো বাড়ির দরোজায়। কোনোভাবে যদি ওই সকল আত্মাদের সঙ্গে কোনো মানুষের দেখা হয়ে যায়, তবে সেই মানুষের ক্ষতি হতে পারে। কারো কারো মতে শুধু মানুষেরই নয়, আবাদি জমির ফসলও নষ্ট করতো প্রেতাত্মাগুলো। সে কারণেই তারা ওই রাতে বিভিন্ন রকম ভূতের মুখোশ ও কাপড় পরে কাটাতো। রাতের বেলা আগুনের পাশে মুখোশ পড়ে বৃত্তাকারে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র পাঠ করতো। আর দরোজার বাহির কিংবা উঠোন জুড়ে রেখে দিতো ফলমূলসহ নানা প্রকার খাবার সামগ্রী (যাতে করে প্রেতাত্মা খুশি হয়ে কোনো অনিষ্ট না করে)। সময়ের পরিক্রমায় কেল্টিক জাতির এই ‘সাহ-উইন’ উৎসবই এখনকার দিনের ‘হ্যালোইন’ উৎসব।
এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে দুটো ব্যাপার জড়িত। একটা হল ট্রিক অর ট্রিট, অন্যটি হল জ্যাকের বাতি।
দিনটিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নানারকম মুখোশ ও বিভিন্ন ভৌতিক চরিত্রের পোশাক পড়ে। কেউ হয় রাজকুমার, কেউবা রাজকুমারী, স্পাইডার ম্যান, ব্যাটম্যান সহ প্রজাপতি বা উইনি দ্যা পুহ্-এর টিগার সাজতেও ভালবাসে। কেউবা ভূতুড়ে পোশাকে যেমন: ডাইনী, পিশাচ, জলদস্যুর সাঁজেও নিজেকে সাজিয়ে নেয়। আর বয়স্ক ব্যক্তিরা ভয়ংকর ধরনের চলচ্চিত্র দেখা কিংবা ভৌতিক পোশাক উৎসব অথবা ভুতুড়ে বাড়ি ও কবরস্থান তৈরি করেন।
শিশুরা বাড়ি বাড়ি আর দোকানপাট ঘুরে দরোজায় নক করে বলে…ট্রিক অর ট্রিট। তখন যে কোনো একটা বেছে নিতে হয় ট্রিক বেছে নিলে বাচ্চাদের কিছু একটা করে দেখাতে হয় আর ট্রিট বেছে নিলে তাদের ঝুলিতে ক্যান্ডি বা খাবার জাতীয় কিছু দিতে হয়।
শুধু মজা করাই নয়, হ্যালোইনের দিনটিতে অনেক শিশুরা ভুত সেজে তহবিল সংগ্রহ করে। পরে ওই সকল সংগৃহিত তহবিল তুলে দেয় বিভিন্ন অসহায় শিশুদের হাতে।
হ্যালোইন উপলক্ষ্যে প্রতিটা দোকানেই যেন পুরো মাসব্যাপী ক্যান্ডি আর কস্টিউম বিক্রির ধুম চলে! ক্রিসমাস ধর্মীয় উৎসব আর হ্যালোইন অনেকটা গল্পনির্ভর সাংস্কৃতিক উৎসবের মতো। ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের পর সবচেয়ে বেশি আয় হয় এই ‘হ্যালোইন উৎসব’ থেকে। যেটাকে ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রতি বছর শত শত বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়ে থাকে।
শুধু মাত্র ইউরোপ কিংবা আমেরিকাই সীমাবদ্ধ নেই হ্যালোইন উৎসব পালন করার বিষয়টি l বাংলাদেশ সহ উৎসবটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
দু’দিন আগেই স্কুল হতে মেয়ে গিয়েছিল পামকিন গার্ডেনে। সেখান হতেই নিয়ে এসেছে একটা পামকিন। উদ্দেশ্য হ্যালোইনের দিন কাটতে হবে ওটাকে। ক্যান্ডি কুড়িয়ে বাসায় ফেরার পর সে তার বড় মামার সাহায্য নিয়ে রং পেন্সিল, ছুরি, ক্যান্ডেল সহ বিশাল আয়োজনের সহিত মিষ্টি কুমড়াটি কাটতে বসে গেলো। এরপর ভেতরে মম দিয়ে জ্বালালো পামকিন লণ্ঠন! আবদার শুরু করলো মুখে ফেস্টুন করতে চায়।
বললাম, আসো; আমি করে দেই। মেয়ের প্রশ্ন …মাম্মি, তুমি জানো ওইটা করতে !? হেসে বললাম, মাম্মি সব জানে ! এঁকে দিলাম ছেলে ও মেয়ের মুখে তাদের বর্ণনা অনুযায়ী কিছু একটা। আয়নায় মুখ দেখে বিস্ময়ে জড়িয়ে ধরলো। বললো আই লাভ ইউ মাম্মি! ভেতরে ভেতরে বললাম…আই লাভ ইউ টু …
খুশিতে চিক চিক করা মেয়ের মুখ দেখে মনে হলো…সৃষ্টিকর্তা বোধহয় পৃথিবীর সকল মায়েদেরই সন্তানের জন্য সকল কাজই করতে পাড়ার মতো অসম্ভব এক ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান।
বেনজির শিকদার
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র