Homeমুক্তমতপরী ও মানবী এবং আমাদের বোধের অগস্ত্যযাত্রা - শাহানা আক্তার মহুয়া 

পরী ও মানবী এবং আমাদের বোধের অগস্ত্যযাত্রা – শাহানা আক্তার মহুয়া 

পরী ও মানবী (এবং আমাদের বোধের অগস্ত্যযাত্রা) – শাহানা আক্তার মহুয়া
পরীমনি অপরাধী কি না, অপরাধী হলে ঠিক কতটুকু অপরাধী – এই বিষয়গুলো খুব পরিষ্কার না হলেও একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে মেয়েটা একটা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, হয়েছে ষড়যন্ত্রের শিকার।
অন্যান্য দেশে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির ছবি প্রকাশ্যে আনা হয় না- কিন্তু বাংলাদেশে মিডিয়া বা প্রশাসন এসব থোড়াই কেয়ার করে। পরীমনির নানা সংবাদ তো বটেই, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে তার ভিডিও। যে মেয়েটিকে এই কিছুদিন আগেও মিডিয়া মাথায় তুলে নাচত, যে মেয়েটির জীবন সাতদিন আগেও ছিল অন্যরকম, আজ তার এই অবস্থা দেখে মায়া হচ্ছে। সত্যিই খুব মায়া হচ্ছে! পরীমনির ক্যারিয়ার তো ধ্বংস হলোই, আগামী দিনগুলোতে কি সে মুক্তি পাবে নিজের কাছ থেকে? তার চারপাশের মানুষগুলো তো আছেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করার জন্য।
হতে পারে পরীমনির জীবনযাপন ছিল উচ্ছৃঙ্খল আর বেপরোয়া, হতে পারে তার সৌন্দর্যকে সে বিত্তের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে, হতে পারে তার ভেতরে এক রকম ঔদ্ধত্য এসেছিল যে ভেবেছিল মিডিয়াসহ অগণন ভক্ত তার পাশে আছে, হতে পারে সে সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকাতে চেয়েছিল কিন্তু তার বিপরীতে সত্যি-মিথ্যা, মনগড়া গল্প বানিয়ে পরীমনির চরিত্রের চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ করে মানুষ যে সোশ্যাল মিডিয়া গরম করে রেখেছে এ কি তার অপরাধের জন্য ভিন্নরকম একটা শাস্তি নয়?
সোশ্যাল মিডিয়ায় পরীমনির ছবি আর রগরগে খবরের সাথে সাথে অনায়াসে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ্যা, পতিতা, রাতের রানী শব্দগুলো। এ যেন অবদমিত পুরুষকূলের বিভৎস উল্লাস! অদ্ভুত বিষয়টা কি লক্ষ্য করেছেন – যৌনতা, সঙ্গম, রমণ সংক্রান্ত শব্দের কিন্তু কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই। বেশ্যা, পতিতা, গণিকা, খানকি, রক্ষিতা, whore, slut, bitch, Call-girl, harlot….অসভ্য, বিশ্রী এই স্ত্রীবাচক শব্দগুলোর পুরুষবাচক সমার্থক শব্দ নেই।
বেশ্যা শব্দটি এসেছে বৈশ্য শব্দ থেকে। বর্ণপ্রথার যুগে হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণীকে বলা হতো বৈশ্য। যেখান থেকে বিকোনো অর্থে এসেছে বাংলা শব্দ ‘বেশ্যা’। এবং এই শব্দটি নারীদের জন্যই একচ্ছত্রভাবে ব্যবহার করা হয়।
এমনকি son of bitch বলে যখন গালি দেওয়া হচ্ছে, তখনো কিন্তু মা’কে জড়িয়েই গালিটা দেওয়া হচ্ছে।
তাহলে কি বিষয়টি এমন যে পরীমনি, পিয়াসা, মৌ’দের কাছে যারা যায় তারা সবাই ধোয়া তুলসিপাতা। পরীমনিরা এইসব সন্তদের জোর করে উঠিয়ে এনে অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে আসছে আর এইসব নাদানেরা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে ভয়ে বাধ্য হয়ে পরীমনির বাসায় গিয়ে দামী দামী মদ খেয়ে তার সাথে সময় কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। পরীমনি চেয়েছে বলে বাধ্য হয়েছে ব্যয়বহুল দুবাই সহ বিভিন্ন দেশে প্লেজার ট্রিপে গেছেন।
আহা, মরি! মরি!
পুলিশ, প্রশাসন, ক্ষমতা যাদের পকেটে তারা ভয়ে ভীত হয়ে কখনো প্রকাশই করতে পারেননি যে পরীমনিরা তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে! অথচ এই ক্ষমতাবলেই কিন্তু তারা পরীমনিদের একরকম উলঙ্গ করে ছেড়েছে। না, তাদের চাঁদমুখ মিডিয়ায় আসবে না, আসবে না জনগণের সামনে কারণ তাদের মান-সম্মান আছে, পরিবার আছে, সামাজিক স্ট্যাটাস আছে। পরীমনির কাছে যেতে বাধা নেই কিন্তু কারা কারা তার কাছে যতো, অর্থের যোগান দিতো, বিলাসী জীবনের রসদ জোগাতো, তাদের তালিকা প্রকাশ করা যাবে না— এতে সম্মানী মানুষদের সামাজিক সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে!
আমরা, মানে জনগণ ভারী ভালোমানুষ। সার্কাস দেখি, সবার দেখাদেখি আমরাও হাততালি দিই, এই লকডাউনের বোরিং সময়ে তুমুল উত্তেজনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাই, ঘুরেফিরে খবরগুলো পড়তে পড়তে ব্যাপক বিনোদন পাই, আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবি- যাক বাবা! আমি তো নই, যার হয়েছে সে বুঝবে!
হাহ্! এই হচ্ছি আমরা। আমাদের চিন্তা, মগজ, বোধবুদ্ধি সবকিছু তুলে রেখেছি ক্ষমতাশালীদের সিন্দুকে।
লেখক- কবি , অনুবাদক। ভ্যাঙ্কুভার,কানাডা।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments