Homeসাহিত্যক্রান্তিকাল - রাজু বিশ্বাসের ছোট গল্প

ক্রান্তিকাল – রাজু বিশ্বাসের ছোট গল্প

ক্রান্তিকাল – রাজু বিশ্বাস
গনেশের মুদিখানাটা পেরিয়েই ভোলার মিষ্টির দোকান। দোকানের শাটারটা অর্ধেক নামিয়ে ভোলা হাতে পলিথিনের গ্লাভস পড়ে খদ্দেরদের শিঙারা দিচ্ছিল। দোকানের কর্মচারী খোকা বলে উঠল, বাবু আমার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। সকাল থেকে আট দশবার হয়ে গেছে। আমায় ছেড়ে দিন।
নাদুস নুদুস চেহারার মাঝ বয়সি ভোলা বলে উঠলো, গত দশ পনের দিন তো লকডাউনে একদিনও দোকান খুলতে পারিনি; প্রায় তেরো কেজি ছানার মিষ্টি সব পচে গেছে; কাল সরকার মিষ্টির দোকান খোলার অর্ডার দিল, আর আজই তোর হাগা শুরু হল!
-কী করবো বাবু, কাল ঘরে চাল ছিল না, মা বাগান থেকে বুনো মানকচু তুলে আনল। সেদ্দ করা কচু শাক খেয়েই রাতটা কাটালাম। সকাল থেকেই এই অবস্থা।
-এই অবস্থা তো কাজে এসছিলি কেন?
-ভাবলাম কাজে না গেলি আপনি তো কিছু দেবেন না, তাই…
-হ্যাঁ রে হাগার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট টষ্ট হচ্চে না তো!
-না তা হচ্চে না।
খোকার বয়স বছর চোদ্দ হবে। ভোলা ময়রার দোকানে রোজে কাজ করে। দিনে চল্লিশ টাকা মাইনে। বাড়িতে মা আর ছোট বোন। বড় দিদি অনেকদিন আগে চলে গেছে এক লড়ির ড্রাইভারের হাত ধরে। খোকা জানে তার দিদি এখন মাটনিয়া বেশ্যাখানায় থাকে। ভোলার ময়রার দোকানটা থেকে বেশ্যাখানাটার দূরত্ব বেশি নয়। ভোলা মাঝে মাঝেই যায় ওখানে। একদিন বলেছিল, আজ তোর দিদির সঙ্গে শুলাম রে খোকা।
ভোলা লোকটা ফিচেল টাইপ। বউ ছেলে মেয়ে সবাই আছে কিন্তু বাজারের সকলে জানে ভোলা একটা আস্ত খচ্চর। মেয়েখোর তো বটেই, ছোট খাটো ছেলেদেরও ছাড় দেয় না। ভোলার ময়রার দোকানের দোতালায় একটা ছোট্ট চিলেকোঠা আছে। সেখানে তার দোকানের নাবালক কর্মচারীদের পায়ু সঙ্গম করে। খোকাকেও একাধিকবার সে ধর্ষণ করেছে। প্রথম দিকে কান্না কাটি করলেও এখন আর কাঁদে না। যতবার তার সঙ্গে ওই সব করে ততবার রোজের সঙ্গে কুড়ি তিরিশ টাকা বাড়িয়ে দেয় ভোলা। খোকা জানে ওই বেশি পয়সাটা কত কাজে দেয়। তাই বাইরের কাউকে সে কথাটা কোনোদিন জানায়নি। একদিন খুব কাঁদতে দেখে মা জিগ্যেস করেছিল, মাকে সে সত্যি কথাটা বলেছিল। কিন্তু বাড়তি টাকাটা হাতে আসতেই মাও নীরব হয়ে গিয়েছিল। খোকার বাবা শিয়ালদা হাসনাবাদ লাইনের ট্রেনে কাটা পড়েছিল। তখন খোকা সবে তিন বছরের। মায়ের একটা বাদামের দোকান ছিল মাছ বাজারের মুখে। মাছ বাজারের ভিতরে পেনসিলের চুল্লুর ঠেক। সেখানে চুল্লুর চাট হিসেবে মাতালরা খোকার মায়ের কাছ থেকে বাদাম আর কাঁচা ছোলা কিনত। কিন্তু একদিন পুলিশ এসে পেনসিলের চুল্লুর ঠেক বন্ধ করে দিল, তার পর থেকে খোকার মায়ের বাদাম বিক্রিও বন্ধ হয়ে গেল।
খোকা ভোলাকে বলল, বাবু আমার আজকের পয়সাটা দিন আমি বাড়ি যাই।
ভোলা ড্রয়ার টেনে খোকার হাতে দশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল, যা বাড়ি যা।
খোকা বেশ মিনতির সুরেই জানায়, আর কিছু টাকা দিন। বাড়িতে একটুও চাল নেই।
-চাল নেই কেন রে, রেশন থেকে তো সবাইকে পাঁচ কেজি করে চাল দিচ্চে।
-আমরা পাইনি।
-কেন পাসনি?
– ডিলার বলল, চাল ফুরিয়ে গেছে; পরের সপ্তায় চাল এলে তাই দেবে। কিন্তু এ কদিন আমরা খাবো কি?
ভোলা বারকোশ থেকে আট-দশ আগের বাসি জিলিপি একটা পলিথিনের ভিতর ভরে খোকার হাতে দিয়ে বলে, যাঃ, এগুলো নিয়ে যা। আর সুস্থ হলে তাই দোকানে আসবি; তার আগে আসার দরকার নেই।
ভোলা সেই দশটা টাকা আর সেই জিলিপির ঠোঙাটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
এখন কৃষ্ণচূড়া সময়। রাস্তায় গত প্রায় তিন চার সপ্তা যানবাহন বন্ধ। গাছগুলো আরক্ত হয়ে আছে ফুলে; একটুও ধুলো নেই কোনও গাছে। ধূসর হয়ে যাওয়া প্রাচীন নগরীর মত জনশূন্য হয়ে আছে গোটা মফসসল। মাঝে মাঝে টহল দিয়ে যাচ্ছে পুলিসের জীপ। দুএকটা বাইক শনশন গতিতে চলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। খোকার দিদি পিউয়া এখানে আসার পর থেকে একদিনের জন্য বাড়ি যায়নি। একদিন মা এসে দেখা করে গেছিল। ভাইটাও আসে না। মাঝে মাঝে একটা বোরখা জড়িয়ে পিউয়া আসে ভোলার দোকানে। দেখে একমাত্র ভাইটা তার মিষ্টির দোকানের এঁটো চামচ-প্লেট সাফ করছে। কখনো কখনো খুব ইচ্ছে করে খোকাকে বুকে টেনে নিতে; কিন্তু পারেনি। এই কদিন বেশ্যা পাড়াতেও খদ্দের পত্তর আসা একদম বন্ধ। বছর সাতাশের পিউয়ার শরীরে এখনো ভরন্ত যৌবন। বহু পুরুষের কামনার আগুন তাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভিতর থেকে খাক করে দিলেও বাইরের চেহারায় তার খুব বেশি ছাপ পরেনি। পিউয়ার সঙ্গে আরও বহু মেয়েই এখন প্রায় অনাহারগ্রস্ত। টানা লকডাউনে তাদের সবারই উপার্জন বন্ধ। সুধা মাসি এ কদিন এতোগুলো মেয়ের পেটের ভাত জুগিয়েছে। কিন্তু আজ সকলকে ডেকে সুধা মাসি জানিয়ে দেয়, আমার দ্বারা আর হবে না বাপু; এবার তোমরা নিজেদের পথ দ্যাখো। গভমেন্ট আমাদের জন্য কোনও ত্রাণ দিচ্ছে না। সমাজসেবিদের চোখেও ন্যাবা ধরেছে; বেশ্যা বলে আমাদের কি পেট নেই? সুধা মাসির গলায় আক্রোশ ঝরে পড়ে।
সুধা মাসির কথায় যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল। পিউয়ারা জানে মাসি এ লাইনে অনেকদিন কাটালেও কোনও মেয়েকেই সে প্রাপ্য থেকে কোনও দিন বঞ্চিত করেনি। সে জন্য মাসিও খুব বেশি টাকা পয়সা গোছাতে পারেনি। আজ মাসির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করতে পারে না তারা। অনেকেই লকডাউন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু এখন আর কারো কোথাও যাবার উপায় নেই। সংক্রামক রোগের প্রকোপ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেছে। তা বাদে বাড়ি গেলেও কেউ তাদেরকে জায়গা দেবে না। বহুদিন আগেই পরিবারের খাতায় এদের অনেক মেয়েই মৃত। পিউয়ার ঘরে আরও তিনটে মেয়ে থাকে। কদম সীমা আর রেহেনা। কদমের বাড়ি উত্তর দিনাজপুর। সীমা আর রেহেনা পাশের গ্রামের মেয়ে। সীমার বয়স একেবারেই কম। বছর সতেরোর সীমা পিউয়াকে মেজদি বলে ডাকে।
সন্ধের অন্ধকার নামছে। অন্য দিন হলে এ সময় এই রাস্তার ধারে খদ্দেরের ভিড় লেগে যায়। তারা জানে এতো সস্তার বেশ্যা মাটনিয়া ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোথাও মিলবে না। পিউয়া সীমা আর কদমকে নিয়ে বহু দিন পর আজ বড় রাস্তাটার ধারে এসে দাঁড়ায়। রেহেনার মাসিক চলছে; তাই সে ঘরেই আছে। একটা ভাঙা পোলের নীচ দিয়ে বয়ে গেছে খাল। অতীতে এই খালটাকে লোকে রূপবতী নামে ডাকত। কিন্তু এখানকার পুরানো বেশ্যাদের মত সেও আজ রূপ হারিয়ে পচা খালে পরিণত হয়েছে। এখন খালটার স্থবির কালো জলের ক্ষীণ ধারায় ভেসে যায় ব্যবহৃত কন্ডোমের টিউব, রক্তাক্ত প্যাড, মদের খালি বোতল, নিষিদ্ধ ড্রাগের শিশি আরও কত জমে ওঠা ক্লেদ। কোনও এক কালে ভরন্ত এই রূপবতীর পারেই গড়ে উঠেছিল সভ্যতার সব চেয়ে প্রাচীন জীবিকাবাজার; বেশ্যাখানা। কত মেয়ের অবাঞ্ছিত জীবন-ইতিহাসের যবনিকা পতন ঘটেছে এই রূপবতীর বুকে। পিউয়ারা সে সব ইতিহাস জানে না। তারা সন্ধের ভাঙা অন্ধকার গায়ে মেখে এগিয়ে যায় এখনকার পচা খালটার বুকে সেই জরাজীর্ণ পোলটার উপর। কেউ কোত্থাও নেই। কৃষ্ণচুড়া গাছের শাখাপ্রশাখার ভিতর কোথাও একটা কোকিল ডেকে চলেছে একটানা। এক ঘেয়ে ডাকটা একদম ভালো লাগে না। কান যেন ঝালাপালা করে। দুপুরে একটুখানি খিচুড়ি জুটেছিল। রাতে খাবার কিছু নেই। সীমা বলে মেজদি আজ কী খদ্দের পাবো?
পিউয়া হলুদ আলো অন্ধকারে ঢাকা শূন্য রাস্তাটার শেষ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, দেখা যাক…
পেটে কামড়ানি নিয়ে খোকা বাড়ি ফিরছিল; জলা পথ। বৈশাখ মাসের শুরু থেকেই এবার বৃষ্টি নেমেছে। মাঠঘাট থই থই করছে জলে। গতবার পঞ্চায়েত ইলেকশনের আগে এই পথটায় ইট পড়েছিল। বর্ষার জল পেয়ে ইটগুলো জায়গায় জায়গায় আলগা হয়ে ভয়ানক কাদা হয়েছে। চলতে গেলে গায়ে মুখে কাদা ছিটকে আসে। তা ছাড়া রাস্তার মাঝ খানে কোনও কোনও জায়গায় গভীর গর্ত করা। তাতে জল জমে টইটম্বুর হয়ে আছে। গর্তগুলো খোঁড়া হয়েছিল কারেন্টের খুঁটি বসানোর জন্য; কিন্তু এক বছর হয়ে গেল খোকাদের গ্রামে কারেন্ট আর এলো না।
বাড়ি ফিরে খোকা দেখল ছোট বোনটা তারস্বরে কাঁদছে। মা বোনটাকে বকাবকি করছে। সকাল থেকে কারো কিছু পেটে পড়েনি। ঘরে না উঠেই বারান্দা থেকে মায়ের হাতে জিলিপির ঠোঙাটা দিয়ে সে ছুটল ওদের ঘরের পিছনে তপনদের পচা খানাটার ধারে। সেখানে খাটা পায়খানাটার প্যানে অর্ধেক জলে ভরে আছে। উপরে বিষ্ঠা ভাসছে। দুর্গন্ধ ভরা বিষ্ঠাগুলোর দিকে তাকিয়ে এখন আর খোকার ঘেন্না করে না। পায়খানায় বসে সে অনুভব করে তার পায়ু ছিদ্রের চার পাশে খুব জ্বালা; পায়খানার কোঁথ পাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালাটা দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে। ভোলা আর তার দোকানের আর এক কর্মচারী মিলে লকডাউনের কদিন আগে তাকে টানা ধর্ষণ করেছে। সে রাতে বাড়ি ফিরতে পারেনি সে। শুয়েছিল ভোলার মিষ্টির দোকানের সেই ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে। মলদ্বার চিরে রক্ত আসছিল। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে পরদিন সকালে বাড়ি এসেছিল সে। তারপর থেকেই মলদ্বারের চারপাশে অসম্ভব জ্বালা করে। রাতে ঘুমাতে গেলেও জ্বালা। মাকে বলতে, খানিকটা জার্মান লতা তুলে এনে রস করে লাগিয়ে দেয় ওখানে। বলে, এরপর করতে চাইলে বলবি আরও টাকা দিতে হবে, তা নাইলে পুলিশকে সব বলে দেব।
কিন্তু ভোলাকে সে কথা বলার আগেই লকডাউন হয়ে যায়। আর দোকানে যাওয়া হয়নি। কাল ভোলা খোকাদের বাড়িতেই এসে বলে যায়, পরদিন থেকে দোকানে যেতে। সকালে প্রচণ্ড পেট খারাপ সত্ত্বেও টাকার আশায় সে গিয়েছিল দোকানে।
পায়খানা থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে খোকার মা ডাক দেয়। বলে, খানিকটা গন্ধভাদাল পাতা পেয়েছি রে খোকা। রস করে রেখেছি, এসে তারাতারি খেয়ে নে।
পাতার রসগুলো খেতে বমি এসে যায় খোকার। এতো বাজে গন্ধযুক্ত রস সে জীবনে খায়নি। অসুধ কেনার তো পয়সা নেই; রোগ বালাই হলে এই সব গাছ পালাই ভরসা। খোকার মা অনেক গাছড়া ওষুধ জানে। খোকার দাদু হাটে কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করতো। দাদুর কাছে শেখা সেই বিদ্যা মাঝে মাঝেই কাজে লাগে। আশপাশের পাড়ার অনেকেই খোকার মায়ের কাছে মাঝে মাঝে আসে গাছড়া ওষুধ নিতে। পাতার রসটা খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আশ্চর্যজনকভাবে খোকার পেট ব্যথা আর পায়খানা কমে যায়। কিন্তু খিদেটা হু হু করে বাড়তে থাকে। ভোলার দোকানের প্রায় পচা জিলিপি খেয়েই দুপুরটা কেটে যায়। মা বলে, খোকা এক কাজ করতে পারিস?
-কি কাজ মা?
-তোর দিদির ওখানে একবার যেতে পারিস?
-কেন মা?
-দিদিকে গিয়ে বলিস কিছু টাকা দিতে; নইলে আমরা খাবো কী? এভাবে আর কতদিন চলবে?
খোকা জানে তার দিদি মাটনিয়া বেশ্যা পাড়ায় থাকে, দিদিকে দেখার ইচ্ছে হলেও সে কখনো ও পথে যায় নি। কী জানি দিদির প্রতি তার কিশোর মনে কী একটা অব্যক্ত অভিমান বাসা বেঁধে আছে। দিদি যদি সেদিন সেই লড়ি ড্রাইভারটার সঙ্গে পালিয়ে না যেত তাহলে হয়তো দিদির জীবনে এমন পরিণতি হত না। একটা ভালো সংসার হতেই পারতো দিদির। এতো কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও খোকা কোনও দিন যায়নি। ভোলা যেদিন শেয়ালের মত হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আজ তোর দিদির সঙ্গে শুলাম রে খোকা। -তখন রাগে দুঃখে খোকার ভিতরটা দুমড়ে যাচ্ছিল; ভোলা যখন তাকে ধর্ষণ করে তখনো এতোটা খারাপ লাগে না তার।
সন্ধে বেলা মায়ের জোরাজুরিতে দিদির কাছে যেতে রাজি হয় খোকা।
অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। রাস্তার দুধারে বড় শিরিষ গাছের শাখাপ্রশাখার ফাঁক দিয়ে কৃষ্ণা পঞ্চমীর সরু চাঁদ দেখা যায়। কোকিলটা আর ডাকছে না। নিস্তব্ধ চারপাশ। রূপবতীর জীর্ণ সেতুটা উপর দাঁড়িয়ে তিনটি মেয়ে চেয়ে শূন্যগর্ভ দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে বড় রাস্তাটার দিকে। কেউ নেই। একটু দূরে মাটনিয়া বাজারে এখনো দু-একটা দোকান খোলা। দোকানের বাইরের আলোগুলো নিভিয়ে এখনো দোকানিরা হয়তো খদ্দেরের অপেক্ষা করছে। দোকানের ভিতরে জ্বলছে মৃদু আলো। চৌরাস্তার মোড়ে একটু আগেও কিছু সিভিক ভলেন্টিয়ার দাঁড়িয়ে ছিল। তারাও চলে গেছে। একটা গা ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ। সন্ধে সাতটার সময় মাটনিয়া বাজারের এ রূপ কখনো দেখেনি পিউয়ারা। রাত দুটো- তিনটে পর্যন্ত এ বাজারের অনেক দোকান খোলা থাকে। চায়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট, বেআইনি মদের দোকানগুলোতে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খদ্দেরের ভিড়ও বাড়ে। দুএকটা ওষুধের দোকানও খোলা থাকে। সেখানে কনডম, সেক্সের ওষুধ, জাপানি তেলের সঙ্গে ইয়াবা ফেন্সিডিলের মত নিষিদ্ধ ড্রাগও পাওয়া যায়। কাছেই ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশ থেকে খুব সহজেই চলে আসে এগুলো। বাজারটা ছাড়িয়ে একটু দূরে বড় রাস্তাটার বাঁদিক থেকে যে সরু রাস্তাটা চলে গেছে সীমাদের গ্রামের দিকে তার মোড়ে একটা বারও হয়েছে ইদানিং।
সীমা বলে, মেজদি খুব খিদে পেয়েছে।
কদম ওকে ধমক দেয়। বলে, সব সময় তোর খাই খাই; এতো খাই খাই করলে চলে। আমরাও তো সারাদিন প্রায় না খেয়ে আছি। খদ্দের না পেলে খাওয়া জুটবে না।
পিউয়া বলে, আহা বকছিস কেন ওকে, বাচ্চা মেয়ে। খিদে তো পাবেই।
-বাচ্চা মেয়ে না হাতি, বিয়ে হলে এতো দিনে তিন বাচ্চার মা হয়ে যেত। তাও তো এলাইনে আসার আগে একবার পেটও খসিয়েছে।
সীমা নীরব হয়ে যায়। তার হঠাৎ মনে পড়ে যায় বাড়ির কথা। বিদ্যাধরী নদীর একেবারে ধারেই জেলে পাড়ায় তাদের এক চিলতে ঘর। নদীর পাঁক তুলে দেওয়াল দেওয়া। মাথায় খড়ের ছাউনি। বাবা নিমাই নদীর চরায় বালি কাটার কাজ করতো। ভাটার সময় বড় ভুটভুটি নৌকা নিয়ে নিমাই শিবু ফকিররা গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে চলে যেত দূরে সেই সিংমারির চরে। জোয়ার হলে ফিরে আসতো। বিদ্যাধরীতে আগে খুব স্রোত ছিল। সীমা খুব ছোটবেলায় দেখেছে অসংখ্য নৌকা চলত নদীতে। মাছ হত খুব। কিন্তু আস্তে আস্তে গতি কমে নদীটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। জেলেরা মাছ ধরার কাজ ছেড়ে বেশির ভাগই ভাঁটায় বালি কাটার কাজ ধরল। একদিন বাবা নৌকায় নিয়ে কাজে চলে গিয়েছিল। বাড়িতে একা ছিল সে। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের ঘোরেই সে একসময় অনুভব করলো তার পরনের ফ্রকটা নিচের দিক থেকে কেউ উপরে তুলে আনছে। একটা শক্ত খড়খড়ে হাত তার গোপন অঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে। চোখ খুলে চিৎকার করতে যাবে, এমন সময় মুখটা দুহাতের তালু দিয়ে চেপে ধরল কেউ। বিস্ফারিত চোখে সীমা দেখতে পেল তার তল পেটের উপর উঠে বসেছে বলরাম দাদু!
টানা দু-তিন মাস ধরে বলরাম দাদুর কাছে ধর্ষিত হতে হতে পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল সীমার। বলরাম সীমাকে বলেছিল, কাউকে যদি বলিস তো তোর গলা কেটে মেরে লাশ ভাসিয়ে দেব বিদ্যাধরীর জলে। কেউ জানতেও পারবে না। ভয়ে কাউকে না বললেও পেটে বাচ্চা এলে পাড়ার সবাই প্রায় জেনে গিয়েছিল ঘটনাটা। শালিস ডাকা হল। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা বলরামের কাছ থেকে কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে ওকে ছেড়ে দিল। সদরের একটা নার্সিং হোমে গিয়ে পেট খসিয়ে আসতে হল সীমাকে। মাস চারেকের একটা জীবন্ত ভ্রূণকে বছর চোদ্দর সীমার রোগা শরীর থেকে বের করে নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল ওরা। তার কিছুদিন পর বাবা নদীতে গিয়েছিল বালি কাটতে। জোয়ারে ফেরার সময় বালি ভরা নৌকা উল্টে গেল। নৌকার নিচে চাপা পড়ল নিমাই। চারদিন পর নিমাইয়ের বিকৃত গলাপচা লাশটা ভেসে উঠেছিল।
অন্ধকার চিরে একটা পুলিশ জীপ এসে দাঁড়াল ভাঙা সেতুটার উপর। ভিতর থেকে কাঁচা খিস্তি ভেসে এলো, খানকির মাগিরা এই লকডাউনের দিনেও ধান্দা করতে বেড়িয়েছিস? গাঁড়ে এতো খিদে!
পিউয়ার হাতটা ধরে সামনে এগিয়ে এলো কদম। তীব্র কঠিন গলায় সে বলে উঠলো, খিদে আমাদের গাঁড়ে নয় স্যার; খিদে আমাদের পেটে।
জীপটার ভিতরে তিন-চারজন খাকী উর্দিধারী পুলিশ। ড্রাইভারসহ সকলেই প্রচণ্ড ড্রাঙ্ক। একজন গাড়ির গেট খুলে নিচে নেমে এলো। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। মাথায় মস্ত টাক রাস্তার হলুদ আলোয় চকচক করছে। মুখ দিয়ে বাংলা চোলাইয়ের ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে । পিউয়ার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে সে বলে, খানকি হলেও সুন্দরী তো কম না। কি নাম তোর?
-পিউয়া।
-বা রে, হেব্বি নাম তো। আসল নাম কী?
-আমার এটাই আসল নাম।
-আমাদেরকে কি পাগল পেয়েছিস, এ লাইনের মাগীরা কেউ আসল নাম বলে নাকি?
কদম বলে, নাম গোপন করবো ক্যান স্যার, আমরা কি চুরি করি না ডাকাতি? ন্যায্য মত গতর বেঁচে পয়সা নিই।
জীপের ভিতর থেকে একজন উর্দিধারী বলে ওঠে, ছেনালি মারাস না। বেশি বকবক করলে গাঁড়ে মোটা রুল ঢুকিয়ে দেবো। এই যে সেন বাবু ওই বুড়ি মালটাকে রেখে এদের দুজনকে গাড়িতে তুলুন।
সীমা আর পিউয়াকে জীপে তুলে ড্রাইভার স্ট্রাট দিল। গাড়িটা ফাঁকা হাইওয়ে দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলেছে। সেনবাবু উল্লাসে গলা ছেড়ে হিন্দি গান ধরেছে। মাটনিয়া বাজারটার কাছে এসেই একটা কিছুর সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে কিছুটা দূর গিয়ে থেমে গেল গাড়িটা।
-কি ব্যাপার বিশ্বাস?
ড্রাইভার বেশ উদ্বেগের সুরেই বলল, মনে হয় কেউ একটা চাপা পড়েছে। বলেই সামনের গেট খুলে সে পিছনের রাস্তার দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সে বলল, একটা বাচ্চা ছেলে স্যার ।
– কত বয়স?
-তা বছর চোদ্দ হবে।
-বেঁচে আছে, না ডেড?
-এখনো বেঁচে। মাথা ফ্রাকচার হয়েছে। মনে হয় বাঁচবে না। ছেলেটা দিদি…দিদি বলে খুব কাতরাচ্ছে স্যার। তুলে আনবো ছেলেটাকে?
-না থাক, দরকার নেই। না বাঁচলে আমরা সবাই ফেঁসে যাবো। হাজারটা লাফড়া হবে। তুই উঠে বস। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।
অন্ধকারটা ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। রূপবতীর ভাঙা সেতুটার উপর এখনো উপবাসী কদম একা খদ্দেরের আশায় পথ চেয়ে আছে। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদটা হেলে পড়েছে পুব দিগন্তের দিকে। শিরিষ গাছের কোটর থেকে একটা বুড়ো তক্ষক পরপর কুড়ি বার প্রাগৈতিহাসিক ক্লান্তি নিয়ে ডেকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল বেশ কয়েকটা বাদুড়।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments