“কতকাল দেখি নি তোমায়”- জাহিদ হাসান
‘আসছি’ বলে দাঁড় করিয়ে রেখে মেয়েরা চলে যায়। আর আসে না। প্রথম দিকে এই নিয়ে অভিযোগ ছিলো। রাগ করে একবার একটা ছড়াও লিখেছিলাম-
“নারীর মাঝে সুধা আছে এই ধারনা ভুল
পাথরকে কি বলতে পারি স্নিগ্ধ গোলাপ ফুল?”
বুদ্ধি হওয়ার পর বুঝেছি, এই সব অভিযোগ সালিস-দরবারে কোন লাভ নেই। ‘আমরা এমনই এসে ভেসে যাই …হাওয়ার মতন, নেশার মতন ঢেউয়ের মতন ভেসে যাই’। অতএব যা আসে তাকে সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে গ্রহণ করো, যা চলে যায় তাকে রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে রেখে দাও। ব্যাস। হাহাকার করো না।
মূল কথায় আসি। পাড়ায় তখন আমার ‘ভালো ছাত্র’ বলে নামডাক। প্রতিবছর আশপাশের জেলা থেকে ছাত্ররা ‘উচ্চ শিক্ষার্থে’ আলমডাঙ্গায় আসে। মেট্রিক পরীক্ষা দিতে কুষ্টিয়া থেকে তেমন তিনিও এসে উঠেছেন আত্মীয়ের বাসায়। আত্মীয়টি চাকরি করেন, আমাদের পাড়ায় ভাড়া থাকেন। একদিন তিনি আমাকে ‘চা খেতে’ ডাকলেন। কথায় কথায় বললেন অংক আর ইংরেজিতে যদি তাঁর ভাগ্নিকে একটু সাহায্য করি। আয়োজনটাও জানালেন এমন, প্রশ্ন আউট হয়ে যাবে পরীক্ষার ঘন্টা পড়ার পরপরই, এক কাজিন রকেটবেগে আমার কাছে প্রশ্ন নিয়ে আসবে, আমি বিদ্যুৎবেগে ‘আঁক কষে’ দেবো চিরকুটে, কেউ একজন ইউসেন বোল্টের বেগে পৌঁছে দেবে বোনের হাতে, বোন তা দেখে দেখে খাতায় লিখে দেবে।
ভাগ্নিকে দেখার আগ পর্যন্ত আমি শক্তই ছিলাম। দেখার পরে রাজি না হয়ে উপায় থাকলো না। ইংরেজি শেষ হলো। অঙ্কের আগে কয়েকদিনের গ্যাপ আছে। ভাগ্নিকে বললাম, ‘কিছু অংক তো একটু বুঝেও নিতে হবে’। তিনি বুঝতে রাজি হলেন। অতঃপর ১৯৮৩ সালের মার্চের কয়েকটি ক্ষণস্থায়ী বিকেলে মামার বাড়ির ছাদে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের এক ছাত্র মেট্রিক পরীক্ষার্থী আরেক বালিকাকে অংক বুঝাতে শুরু করলো। অংক এমন একটা জিনিস, বুঝাও শক্ত, বুঝানোও শক্ত। সুতরাং দেরি হতে লাগলো। এভাবে একদিন আকাশের ৪৫ডিগ্রী কোণে যখন প্রকাশ্যে চাঁদ উঠে গেলো, অঙ্কের কোনো এক রহস্যময় সূত্রের গুনে বালিকাটি গেয়ে উঠলেন …’বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি …কতকাল দেখি নি তোমায়…।’
আর দেখা হয়নি জীবনে। কোথায় আছেন তিনি, জানি না। শুধু জানি, ‘একবার চলে গেলে নারীরা ফেরে না’। যতক্ষণ সাথে থাকে, নারীকে সম্মানে, মায়ায়, যত্নে মাথায় করে রাখতে হয়। এই মাথায় করে থাকাটুকুই থাকে, আর কিছু থাকে না। তাহলে লিখছি কেন? লিখছি এই ছড়াটা যদি তাঁর চোখে পড়ে।
বুড়িয়ে গেছো, বাতের ব্যথা?
চুল কি পেকেছে ?
তোমার মেয়ে, একলা ছাদে,
আকাশ দেখেছে?
আমার ছেলেও, গান শোনে খুব,
মধ্যরাতে জাগে।
আমরাতো নই, তাঁরাই এখন,
ভিজছে অনুরাগে।