Homeসাহিত্যরাজু বিশ্বাসের কয়েকটি অণুগল্প

রাজু বিশ্বাসের কয়েকটি অণুগল্প

অণুগল্প
থাবা
উত্তাল জল। বিশাল সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলেছে মাতলা নদী। পারে ম্যানগ্রোভের অরণ্যে সবুজের জটাজাল। শেষ বিকেলের হলুদ আলো ছলকে পড়েছে নদীর জলে। অসংখ্য পরিযায়ী ডানা মেলেছে ছিন্নমূল মানুষের মতো। বাদাবনের গভীরে ওঁৎ পেতে আছে বিভীষিকা। কিনারায় মুখ ডুবিয়ে কুমির। তবুও জলে নেমে নোনা কাঁকড়া ধরতে ব্যস্ত মেয়ে মরদ।
হালিম শেখের ডিঙিটা নোনা হাওয়াতে মোচার খোলার মতো দোল খাচ্ছে। হালিমের বছর সাতেকের ছেলে জামাল নৌকায় বসে দেখছিল মাতলার ঘোলা কালো জলের ঘূর্ণি থেকে কত সাবানের ফ্যানা বের হচ্ছে। সন্ধার অন্ধকার সুন্দরবনের সুন্দরী গড়ান গেওয়া হেতাল গাছের ফাঁকফোকরে শেষ বিকেলের হলুদ রোদ্দুরকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। জামালের চোখ নদীর জল থেকে উঠে গেল দূর দিগন্তের রঙিন ক্যানভাসে। আকাশে তার মায়ের লাল শাড়ির আঁচল উড়ছিল। জামাল নির্বাক হয়ে দ্যাখে।
অন্ধকার নামতেই হালিম ফেরে। নোনা কাঁকড়া আর বাগদা চিংড়ি ভরা পাত্রটা উঠোনে নামিয়ে রেখে হালিম বৌকে ডাক দেয়, ‘রুকসানা…’ কোনও উত্তর আসে না। জালটা বাইরের ভাড়ায় টাঙিয়ে দিয়ে হালিম ছেলেকে নিয়ে গোলপাতায় ছাওয়া কুঁড়েটায় ঢোকে। শূন্য ঘর। ঘরের পিছন দিকের বেড়া ভাঙা। কঞ্চির বেড়ার গায়ে তাজা রক্ত লেগে। নোনা মাটিতে রয়্যাল বেঙ্গলের থাবার চিহ্ন।
জামাল হঠাৎ ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ছুটে যায়। হতবাক হালিম দেখতে পায় ছেলেটা মা… মা… বলে চিৎকার করতে করতে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে…
অণুগল্প
রাধা ও কৃষ্ণ
পাশাপাশি দুটো গাছ; কৃষ্ণ আর রাধাচূড়া। একদিন খুব ঝড় উঠল। কৃষ্ণ মড়মড় করছে। রাধা একটু ছোট। সে ভয়ে জড়সড়। ঝড়টা আস্তে আস্তে আরও বাড়ছে। কৃষ্ণ রাধাকে ডেকে বলল, ওগো রাধা আমি যদি ভেঙে পড়ি, তুমি একলা কেমন করে থাকবে?
রাধা বলল, আমিও তবে ভেঙে পড়বো।
কৃষ্ণ বলল, না আমি যদি ভাঙি, তুমি কিন্তু ভেঙো না।
-তুমি না থাকলে আমায় ঝড় থেকে কে বাঁচাবে?
কৃষ্ণ প্রচণ্ড দুলতে দুলতে বলল, অপেক্ষা কোরো, দেখবে আমার শিকড় থেকে আর একটা গাছ জন্মাবে, সে বড় হয়ে তোমায় বাঁচাবে।
রাধা বলল, সে বড় হতে হতে আমি তো বুড়ো হয়ে যাবো!
এমন সময় উত্তাল ঝড় মত্ত হাতির মত কৃষ্ণচূড়াকে মাটিতে উপড়ে ফেলল। মুমূর্ষু কৃষ্ণ মাটিতে শুয়ে কাতর স্বরে বলল, রাধা তুমি আমাকে যেন ভুলে যেও না। বিদায়…
ঝড় থেমে গেল। রাধাচূড়ার হলুদ ফুলগুলো মাটিতে লুটোচ্ছে। পরদিন কিছু কাঠুরিয়া এসে কৃষ্ণের মৃত শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে গাড়িতে তুলতে লাগলো। রাধা আর্তনাদ করে বলল, ওগো কাঠুরিয়া তোমাদের পায়ে পড়ি, তোমরা আমাকেও কেটে নিয়ে যাও…। কিন্তু রাধার সেই আর্তস্বর কিছুতেই কাঠুরিয়াদের কানে পৌঁছল না। তারা কৃষ্ণের শরীরটা নিয়ে দূরে যেতে যেতে একসময় পথের বাঁকে হারিয়ে গেল।
পত্রপুস্পহীন একলা রাধা অপেক্ষা করতে লাগল আর একটা সর্বগ্রাসি কালবৈশাখীর…
অণুগল্প
বাবা
আমাকে তোমার সঙ্গে নাও বাবা, আমি পিছিয়ে পড়ছি। দেখো কেমন ঝড় বইছে। অন্ধকার চারপাশ। আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না বাবা। তুমি কোথায়, কতদূরে?
-আমি তোর একটু আগেই আছি। আমার পিছন পিছন আয়।
– আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না বাবা। এতো ঝড় হচ্ছে, আমার খুব ভয় করছে ।
-ভয় নেই। আর একটু জোরে হাঁট। এতো আস্তে চললে পিছিয়েই তো পরবি বাবা।
-বাবা, ওই তো তোমার সাইকেল! কিন্তু তুমি কোথায়? তোমার সাইকেলটা একা একাই তো এগিয়ে চলেছে; তুমি কোথায় আছো বাবা?
-ভালো করে তাকিয়ে দেখ, ঠিক আমায় দেখতে পাবি। আমি তোর কাছাকাছিই আছি।
– না। বাবা তুমি কোথাও নেই। তুমি বারবার ঠকাচ্ছ আমায়। গত সতেরো বছর ধরে আমি তোমায় খুঁজছি। তুমি মিথ্যেবাদী। বারবার বলছ আমার সঙ্গে আছো। কিন্তু তুমি আসলে কোথাও নেই। আমাকে মিথ্যে বলছ। আমি আর পারছি না বাবা। আমি আর একা হাঁটতে পারছি না। দয়া করে তুমি এসে আমার হাত ধরো বাবা। আমি তোমার কাঁধে চরে শালুকবিলে যাবো। তুমি মাছ ধরবে ছিপ দিয়ে, আমি বড়শিতে চার গেঁথে দেবো। আমরা দুজন সিংমারির মাঠে পটোল গাছে ফুল ছোঁয়াতে যাবো। তারপর ফেরার পথে কালো পিসিদের পুকুর থেকে কলমি শাক তুলে আনবো। মা খুব খুশি হবে দেখো। বাবা… ও বাবা তুমি আর কথা বলছ না কেন?
– ধুর পাগল ছেলে আমার। আমি তোর সঙ্গেই আছি বাবা। একবার তোর দুচোখ ছুঁয়ে দেখ।
-কই বাবা, আমার চোখে তো শুধুই জল।
– ওই জলের ফোঁটাগুলোই তো আমি পাগল। যতদিন তোর চোখে এই জল থাকবে, আমি ততদিনই তোর সঙ্গে থাকবো। কোত্থাও যাবো না তোকে ছেড়ে।
-আমি তবে সারাজীবন কাঁদবো বাবা। তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যেয়ো না…
অণুগল্প
জামাইষষ্টি
প্রথমবার জামাইষষ্টিতে ডাক পেয়েছে গোপাল। আট মাস আগেই বাবুখালির শ্যামদাস মাঝির মেয়ে টুসির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার। সুন্দরবনের তিনটে নদী পেরিয়ে নৌকায় করে বিয়ে করতে এসেছিল সে। কালো পাথরের মতো নিটোল মুখের সেই মেয়েকে ঘরে আনার পর তার সৌভাগ্যের বন্ধ দরজাটা হঠাৎ খুলে গেছে। মাছের ব্যবসায় জোয়ার এসেছে। শ্বশুর শ্যামদাসের টুসি ছাড়াও আর একটা মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল সাতজেলিয়ায়। কিন্তু ওর বরটাকে বাঘে খেয়েছে। জঙ্গলে মধু ভাঙতে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। সেই থেকে বাপের বাড়িতেই থাকে টুসির দিদি মৌসুমি।
গোপাল টুসিকে নিয়ে মাতলা পেরিয়ে যখন বাবুখালিতে পৌছালো, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কদিন আগেই ভরা কোটালে নদীর বাঁধ ভেঙে ভেসে গেছিল গ্রাম। নদীর জল অনেকটা নেমে গেলেও এখনো গ্রামের মাঠগুলো জলে থই থই করছে। গ্রামের চারদিকে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। কারো বাড়িঘরও তেমন চোখে পড়ছে না। দূরে একটা ভেরির উপর কয়েকটা ত্রিপল খাটানো। ওখান থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মনে হয় রান্না হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে গোপাল দেখল খড়ের ছাওয়া ঘরটার মেঝেতে এখনো গোড়ালি ভেজা জল। বাঁশের একটা ধরাটের উপর বসতে দেওয়া হয়েছে তাকে। একটা স্টিলের ছোটো থালায় কয়েকটা কাটা আম, কলা আর কিছুটা সন্দেশ সাজিয়ে দিয়ে শ্যামদাসের বৌ আলো মুখে একটু শুকনো হাসি এনে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, তেমন কিছু জোগাড় করতে পারিনি বাবা; বন্যায় সব ভেসে গেছে।
টুসি ওর দিদির পাশে বসে শ্বশুরবাড়ির গল্প বলে যাচ্ছে। বছর কুড়ির বধূ টুসির দুচোখে যেন রূপকথার আলো। গর্বিত স্বরে সে বলে যায় শ্বশুরবাড়ির সুখ-সাচ্ছন্দের কথা। গোপাল তাকে বড্ড ভালবাসে। শ্যামদাস মেয়ের বিয়েতে তেমন কিছুই প্রায় দিতে পারেনি। বিয়ের পর গোপালই তার সোনার ‘হাতের কানের গলার’ অলংকার গড়িয়ে দিয়েছে। বোনের কথা শুনতে শুনতে মৌসুমি দেখতে পায় সামনে উত্তাল একটা নদী। একটা ছোটো ডিঙিতে ভেসে যাচ্ছে তার কানাই। সারাদিন পর এক নৌকা মাছ বোঝাই করে সে ঘরে ফিরেছে। তার ইস্পাতের মত শক্ত শরীর বেয়ে নেমে আসছে ঘামের ধারা। একগাল হাসি নিয়ে সে তার আঁচলের প্রান্ত ধরে মুখের ঘাম মুছে নেয়। সেবার একটা কচি কলাপাতা রঙ শাড়ি কিনে এনে বলেছিল, এবার জামাইষষ্টিতে এটা পরে যেয়ো আমার সঙ্গে…
বাবুখালির চরে সন্ধের গভীর অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। জলমগ্ন গ্রামটার কোনও ঘর থেকে আজ আর শঙ্খের ধ্বনি ভেসে আসে না। ঈশান আকাশে এক খণ্ড মেঘ জমেছে। কৃষ্ণপ্রিয়া নদীটার জল থেকে হুহু করে ছুটে আসছে ঠাণ্ডা হাওয়া। একটু পরেই বোধহয় বৃষ্টি নামবে…
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments