চক্রব্যূহ
রাজু বিশ্বাসের ছোটগল্প
আজ হাতে তেমন কোনও কাজ ছিল না। বসেছিলাম বাবলুর চায়ের দোকানে। শীতের সকালের একটা আলাদ আমেজ আছে, সেটা আমাদের এই আলসেখানায় না এলে বোঝা যাবে না। গ্রামটার আসল নাম আলসেখানা হলেও এখানকার মানুষজন মোটেও অলস নয়। বরং রীতিমত কর্মপ্রিয়। সকাল থেকেই সবাই কোনও না কোনও কাজে ব্যাস্ত। কিছুটা দূরেই ঘোজাডাঙা চেকপোস্ট। রোজ হাজার হাজার ট্রান্সপোর্টের ট্রাক মাল বোঝাই করে যাচ্ছে আর আসছে। চওড়া রাস্তার ধারে গজিয়ে উঠেছে অনেকগুলি পেট্রোল পাম্প, কিছু বিল্ডার্সের দোকান, ধানকল আর ‘সুধা ধরম কাঁটা’। কিছু ইটভাঁটা বহুদিন আগে থেকেই আছে, তবে নতুন করে আর কোনও ভাঁটা তৈরি হয়নি।
অসংখ্য গাছ-পালা এখনো পথের দুপাশে। রাস্তা বড় করার জন্য বহু গাছ কাটা হলেও এখনো যেগুলো আছে চোখ জুড়িয়ে যায়। কয়েক জায়গায় জলা জমি, ধানক্ষেত পরিস্কার করে কংক্রিট বাঁধিয়ে তৈরি করা হয়েছে পার্কিং এরিয়া। শ’য়ে শ’য়ে বিশাল ট্রাক সেখানে দাঁড়িয়ে। সুধা ধরম কাঁটায় গাড়িগুলো ওজন হয়ে সোজা চলে যায় চেকপোস্টে। সেখানে বি এস এফরা গাড়ির কাগজপত্র চেক করে একে একে ছাড়ে। প্রতিদিন বর্ডার থেকে দু-তিন কিলোমিটার পর্যন্ত গাড়ির লাইন লেগে যায়। বেশ কয়েকটা বিউটি পার্লার আর ছোটবড় ব্রথেলও জন্ম নিয়েছে ইদানিং; পাঞ্জাবি ড্রাইভার খালাসি থেকে শুরু করে সীমান্তরক্ষী সবাই ওদের লক্ষ্মী।
আমি এলাকার ছেলে। কাজ করি একটা পেট্রোল পাম্পে। রোজ কত ধরণের মানুষের সাথে সাক্ষাত হয়। আজ শনি বার। গাড়ির তেমন চাপ নেই। পাম্পের সামনে বাবলুর চায়ের দোকানে বসেছিলাম। এটাকে চায়ের দোকান বললে ভুল হবে, ছোটখাটো একটা হোটেলও। সকালবেলা রুটি-তরকা থেকে শুরু করে দুপুরে-রাতে মাছ-মাংস ভাত পর্যন্ত সব কিছু পাওয়া যায়, তাছাড়া মুদিখানার টুকটাক জিনিসপত্রও এখানে মেলে।
বাবলু আমারই বয়সি। মাধ্যমিক দেওয়ার পর ওর বাবা এই দোকানের সামনে গাড়ি চাপা পড়ে মরল। রাস্তা পার হয়ে চা দিতে যাচ্ছিল পাম্পে। হঠাৎ একটা ষোল চাকার লড়ি এসে বাবলুর বাবাকে পিষে দেয়। বাবলুর পড়াশুনোয় সেখানেই ইতি। চায়ের দোকানটাকে ভালো করে গুছিয়ে নিয়েছে ও। রাস্তার ধারে দু-কাঠা জমি কিনে বাড়িও করেছে। মা আর এক ভাইকে নিয়ে বাবলুর সংসার। আমায় ওর মা খুব ভালবাসে। আমার মা ছোটবেলায় ডেঙ্গুতে ভুগে মারা গেছে। বাবাহীন বাবলু আর মা-হারা আমার মধ্যে একটা আশ্চর্য বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যদিও আমরা ছেলেবেলার বন্ধু নই। বাবলুরা থাকতো শরৎখালির পারে ছোট একটা চালাঘরে। ওর বাবার একটা ছোট ঝুপড়ি চায়ের দোকান ছিল এখানে। এখন বাবলুর আমলে সেই দোকানটাই বিশাল হয়ে উঠেছে।
বাবলু আমায় বলে, পাম্পের কাজটা ছেড়ে দিয়ে একটা নিজের মত ব্যবসা খোল না।
আমি বলি, ব্যবসা যে খুলবো, পুঁজি কোথায়?
বাবলু উৎসাহের সঙ্গে বলে, আমার কাছ থেকে না হয় কিছু ধার নিবি, পরে ব্যবসা বাড়লে শোধ দিয়ে দিবি।
-যদি না পারি?
-অবশ্যই পারবি। এই বর্ডার এরিয়ায় কয়লা ফেললে হীরে হয়ে যায়। দেখছিস না শরৎখালির উপর সেতুটা হবার পর এলাকার মানুষ কেমন ফুলে উঠছে দিন কে দিন। তুইও পারবি।
সত্যি বাবলু ঠিকই বলে। লোকের পাম্পে গোলামী করার চেয়ে নিজে কিছু চেষ্টা করাই ভালো। বাবা বলে ব্যবসার মত লক্ষ্মী জিনিস আর কিছু নেই। বাবা এখন প্যারালিসিসের রুগী। সারাদিন ঘরেই শুয়ে থাকে। দিদির বয়স অন্তত তিরিশ; এখনো বিয়ে হয়নি। বাবা একবার খুব চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দিদির বুকে টিউমার হওয়ায় একটা স্তন অপারেশন করে বাদ দেওয়া। বিসদৃশ বুকের দিকে তাকিয়ে ছেলের বাড়ির লোক মুখ ব্যাজার করে চলে যায়। স্তন না থাকলে সে মেয়েকে মেয়ে বলবে কে! দিদির আর বিয়ে হবে না কোনও দিন, আমি জানি।
বসেছিলাম। বাবলু চা বিস্কুট দিতে দিতে বলল, একটা দরকারি কথা, আছে ভিতরে আয়।
আমি ওর দোকানের ভিতর গিয়ে বললাম, কি দরকারি কথা?
বাবলু খুব আস্তে আস্তে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, রাতের বেলার কাজ করতে পারবি? দু’দিনেই মালামাল হয়ে যাবি।
আমি বললাম, কাজটা কী?
-আরে আমাদের এলাকার জলেশ্বর বিশ্বাসের কাজ। গত পরশু নিজে এসেছিল আমার দোকানে। ওনার বেশ কয়েকজন বিশ্বাসী আর সাহসী ছেলে দরকার।
-আরে কাজটা কী আগে বলবি তো! – আমি উত্তেজিত।
-বেশি কিছু নয়, ওনার লোক থাকবে ওপারে। বি ডি আরকে নিয়েও কোনও টেনশন নেই। সপ্তায় মাত্র দু’তিন দিন কাজ করতে হবে…
এবার আমি ওকে তাড়া দিয়ে উঠলাম। বললাম, কী গরু পাচার করতে হবে, না সোনা?
-ও বলল, গরুও নয়, সোনাও নয়।
-তবে!
-মেয়ে।
-মেয়ে! মানে?
-হ্যাঁ।
-কীভাবে?
বিলের ধারে বেশ কয়েকটা জায়গা আছে, ওপারে খাগড়া বাগান। তার ভিতর দিয়ে পথ আছে, তোকে সপ্তায় দশ বারোটা করে মেয়ে ওপারে দিয়ে আসতে হবে। ওপারে ওদের লোক থাকবে। তোকে বেশি দূরে যেতে হবে না। শুধু ভেড়ি পর্যন্ত তুলে দিয়ে এলেই হল। তারপর ওদের দায়িত্ব। তবে…
-তবে?
– ওপার থেকেও কিছু বাংলাদেশের মেয়েকে মাঝে মাঝে এ পারে আনতে হবে।
-কেন?
-আমাদের দেশে বাংলাদেশী মেয়ের খুব ডিম্যান্ড। আর আমাদের দেশ থেকে যেগুলো যায়, ওদেরকে কিছু দিন বাংলাদেশে কাজ করিয়ে তারপর পাচার করে দেওয়া হয় দুবাই থাইল্যান্ড মায়ানমার ফিলিপাইন্স কাম্পুচিয়ায়।
-আর ওদেশের মেয়েগুলোকে কোথায় নিয়ে আসা হয়?
-আমাদের দেশে তো বেশ্যাখানার অভাব নেই, তবে যতদূর জানি ওদেরকে কলকাতার সোনাগাছি, মুম্বাইয়ের কামাথিপুরা, দিল্লির জি বি রোডের ধারের নিষিদ্ধপল্লিতে। আরও কিছু যায় উত্তরপ্রদেশ বিহার এই সব জায়গায়।
আমি বললাম, ডেঞ্জারাস!
-না, ধুৎ, কিচ্ছু ডেঞ্জারাস না; রিস্ক না নিলে এ বাজারে কেউ বড় হতে পারে বল? তাছাড়া এখানে যারা আধ পেটা খেত, পড়নের কাপড় জুটতো না তারা এখন দু’চারটে করে গাড়ি-বাড়ির মালিক। তুই কি ভাবিস এসব সৎ পথের টাকায় হয়েছে? কক্ষনো না। এতে কোনও দোষ নেই; সবাই করছে, আমরাও করবো।
-বেশ তবে আমরাও…
২
মেয়েটার বয়স তেরো কি চোদ্দ হবে। এতো কম বয়সি মেয়ে আগে কখনো নিয়ে যাইনি। সকাল থেকেই মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি কোথায়?
মেয়েটা জবাব দিল, মুর্শিদাবাদ।
-মুর্শিদাবাদ থেকে এখানে এলে কেমন করে?
পড়নে একটা ময়লা টুপার। বাঁ দিকের গালে একটা পোড়া দাগ দেখতে পেলাম। রোগা চেহারা। যৌবনের কুঁড়িগুলো ফুল হয়ে ফুটতে এখনো অনেক দেরি। এতো কম বয়সি মেয়েটারও নিস্তার নেই! শুষ্ক মুখে ছলো ছলো দুটো ফ্যাকাসে চোখ তুলে মেয়েটা বলল, সৎ মায়ের কাছে থাকতাম। আমার মা বিষ খেয়ে মরেছিল। বাবা আবার একটা বিয়ে করলো। একদিন মাছের তরকারিতে বিড়ালে মুখ দিলে নতুন মা আমার গালে গরম খুন্তির ছ্যাকা দিল।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে মেয়েটা বলছিল। মেয়েটার বাঁদিকের গালের পোড়া ঘা-টা এখনো ভালো করে শুকোয়নি। দগদগ করছে। আমি বললাম, তারপর?
-তারপর রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। ট্রেন ধরে শিয়ালদা স্টেশনে আসার পর দু’জন লোক আমায় বলল, ওদের বাড়িতে কাজ দেবে। আমাকে নিয়ে ওরা একটা হলুদ গাড়িতে তুলল, বিস্কুট খেতে দিল। তারপর আমি আর কিছু জানিনে। রাত্তিরবেলা দেখলাম…
মোট চারটে মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে গেল জলেশ্বরের কালো কাঁচ ঢাকা সাফারিটা। বাবলুর চায়ের দোকানেরই পিছনে মাটির নিচে একটা গোপন ঘর আছে। মেয়েগুলোকে দিনের বেলা এনে ওখানেই রাখা হয়। তারপর রাত গভীর হলে ওদেরকে নিয়ে দিয়ে আসা হয় ওপারে। কোনও কোনও দিন বর্ডারে সমস্যা থাকলে তিন চার দিন ধরে মেয়েদেরকে সেই অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা হয়। একটা একশো ওয়ার্ড-এর হলুদ বাল্ব জ্বলা সেই ঘরে কোনোভাবেই বাইরের আলো-বাতাস ঢোকে না। বাবলুর দোকানের মেঝে দিয়েই ওই ঘরে নামার সিঁড়ি। এ সব বাবস্থা খুব বেশি দিন আগের নয়। এখন বাবলুর চায়ের দোকানটা স্রেফ শো, আসল খেলাটা চলে দোকানের নিচে। ওদেশ থেকে যাদের আনা হয় তাদেরকেও এই ঘরে কিছুদিন রেখে তারপর জলেশ্বরের গাড়ি এসে নিয়ে তুলে যায়। বাবলু যে ভিতরে ভিতরে এতো তুখোড় হয়ে উঠেছে এ সব জেনেছি এ কাজে লাগার পর। আগে আমার এতো প্রিয় বন্ধু হয়েও ঘুনাক্ষরে সে আমায় কিচ্ছুটি জানতে দেয়নি।
জলেশ্বরের নেক নজরে পড়ে বাবলুর অবস্থা আগের থেকেই ফিরতে শুরু করেছিল। এখন আমারও আঙুল ফুলে কলাগাছ। রাস্তার ধারে প্রায় পাঁচ কাঠার একটা সম্পত্তি কিনে বাড়ি করেছি। বাইক কিনেছি। বাবার চিকিৎসা চলছে। দিদির বিয়ের জন্য আবার পাত্র খোঁজা শুরু হয়েছে। ঘটক অনেকগুলো ভালো ছেলের সন্ধান নিয়ে এসেছে। এখন মেয়েদের তিরিশ বছর বয়স নাকি তেমন বেশি কিছু না; আর একটা স্তনে সমস্যা থাকলে কি হবে, অন্যটা তো অক্ষত। তাই বিয়ের বাজারে আমার দিদি এখন বেশ ভালো পাত্রী।
মুখপোড়া মেয়েটার পাশেই জড়সড় হয়ে বসে আছে আমার দিদির বয়সিই একটা মেয়ে। বেশ রূপসী। জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী?
-কৃষ্ণা।
-বাড়ি?
বাধ্য ক্রীতদাসীর মত মেয়েটা জবাব দিল, ভুবনেশ্বর।
-এখানে এলে কীভাবে?
-প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। বর আমার সঙ্গে কিছুদিন সংসার করে তারপর ওর মাতাল বন্ধুদের হাতে আমায় ছেড়ে দিল। ওর চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে একটা ঘরে আটকে রেখে আমার হাত পা বেঁধে রোজ রোজ…
মেয়েটার গলা আটকে এল। বলল, জল খাবো।
ওকে জল দিলাম। ঢক ঢক করে পুরো জলটা খেয়ে আবার বলতে শুরু করলো, ও আর ওর বন্ধুরা মিলে প্রথমে আমায় সোনাগাছির এক মাসির কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপর ওখান থেকে আবার বিক্রি হয়ে গেলাম। দালাল বলেছে, আমাদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে তারপর ওখান থেকে পাঠানো হবে দুবাই। ওখানে গেলে নাকি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবো! আচ্ছা ভাই তুমি কি জানো আমাদেরকে আসলে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে?
এ মেয়েটা অনেক সাবলীল; আমার বয়স কম দেখেই হয়তো সাহস করে ভাই বলে ডেকেছে। ডাকুক। ভাই বলে কিছু হয় নাকি, আসলে আমরা তো দালালের জাত। এ রকম কত মেয়ে আসে। ছোট হোক বা বড়, তাতে আমার কী? আমি তো আর মেয়েগুলোকে নষ্ট করছি না। ওরা কেউ আমার বোন, কেউ দিদির বয়সি, কেউ বা বোনের… কোনও সমস্যা নাই। ওরা তো আসলে সুস্বাদু মাংসপিণ্ড। ঈদের আগে বাংলাদেশে যেমন এদেশ থেকে হাজার হাজার গরু পাচার হয়, ওদেশে চড়া দামে বিক্রি হয় সেই গরুর মাংস; তেমনই এই মেয়েগুলোও তো আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে লোভনীয় মাংস। মানুষ তো খাবেই। তাতে দোষের কিছু নেই।
৩
একটা ঠাণ্ডা এলোমেলো হাওয়া শূন্য বিল জুড়ে পিশাচের মত পাক খাচ্ছে। আকাশে মেঘেরা পোয়াতি হয়েছে। বৃষ্টি আসবে। বাজারের গুমটির আলোগুলো নিভে গেছে। শুধু জ্বলে আছে বর্ডারের লম্বা লম্বা হলুদ সার্চ লাইট। ও গুলো যেন দানবের এক একটা চোখ। শত ঝড়বৃষ্টি, লোডশেডিংয়েও নেভে না।
সামনেই খাগড়ার বন। মাঝখান দিয়ে শুঁড়ি পথ। ও পারে মেছো ভেড়ির মাথায় দু’চোখে রিরংসার মশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চপাণ্ডবের বংশধর। কুন্তি দ্রোপদী উলুপী আর অম্বালিকাকে নিয়ে আমি ক্রমশ শেয়ালের মত এগিয়ে চলেছি অভিশপ্ত এক চক্রব্যূহের দিকে…