সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র উঠোনে আমরা
বেনজির শিকদার
২৭শে মে, শুক্রবার, ২০২২, ছিল ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র নিয়মিত মাসিক সাহিত্য আসরের দিন। নিউইয়র্ক-এর অলিগলিজুড়ে ফুটে থাকা টিউলিপ, চেরি আর ম্যাগনোলিয়ার মতো, প্রিয় মুখগুলোর প্রস্ফুটিত সৌন্দর্যে সেজে উঠেছিল প্রিয় প্রাঙ্গণ।
অযাচিত দীর্ঘ বিরতির পর নিশিডাকাতের মতো করোনা মহামারীর ভয়ার্ত জবরদখলের ভেদ কাটিয়ে করোনা পরবর্তী; এটা ছিল আমাদের চতুর্থ আসর।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মাসজুড়ে কর্মব্যস্ততার পর, প্রিয় এই ঘরটিকে কেন্দ্র করে, পোড়-খাওয়া ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মন; খুঁজে পায় নির্মল ভালোবাসার মধুঋতু। যেন দীর্ঘ উপবাস শেষে, উপস্থিত সকলের কথা-কবিতা আর নিটোল আলোচনায় শূন্যতার অভাব ঘুচে তৈরি হয় এক প্রশান্তিময় আবহ।
সে-কারণেই লক্ষণীয়, প্রায় তিনঘণ্টাব্যাপী চলা আসরটিতে প্রতিটি প্রাণবিক মুখই বসে থাকে, ধৈর্য্যশীল চাঁদের মতো। শুধু তাই নয়, প্রার্থনার মতো এহেন কর্মযজ্ঞ ভেতরে তৈরি করে দেয় এমন এক অনুভবের জগৎ; যেখানে প্রথম বারের মতো কোনো পরাক্রান্ত লাস্যময়ী মনও যদি আসে; সেও অনায়াসেই থিতু হতে চায় নিশ্চুপ বেড়ালের মতো।
আসরের শুরুতেই শ্রদ্ধাবনত হয়ে শুনছিলাম, সদ্য-প্রয়াত সাংবাদিক ও লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর অমর সৃষ্টি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” একুশের প্রাণ-কাঁপানো গানটি। সাহিত্য একাডেমির পক্ষ থেকে তার প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি গুণীজনদের মুখনিঃসৃত কথায় বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার বর্ণাঢ্য সাহিত্যসম্ভার এবং অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে তার আপোষহীন লেখালেখির জগৎ সম্পর্কে। যেখানে দিপ্তিপ্রভায় উচ্চারিত বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, এবং বাঙালি জাতির কথামালা, লেখা হয়েছে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকাল নিয়ে অজস্র দিকনির্দেশনা কিংবা কঠিন সমালোচনা ।
এছাড়াও মানবিক ঔদার্যে আসর চলাকালীন, বর্তমান পৃথিবীর এই দুঃসময় ঘিরে, প্রত্যেকের কাছ থেকেই স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট ভাবের আবর্তে উচ্চারিত হচ্ছিল, সকরুণ মর্মবাণী।
করোনার ভয়াবহতায় শঙ্কিত হৃদয় নিয়ে দীর্ঘদিনের নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা অপেক্ষার পর, অস্থিরমতি মন স্বপ্নাতুর পেলবতায় কিছুটা স্থিত হতে না হতেই যুদ্ধের বীভৎসতা, স্কুলপড়ুয়া শিশু থেকে জীবনসংগ্রামী বৃদ্ধের মৃত্যুমিছিলে পৃথিবী আবারও দোদুল্যমান। আজ আমেরিকার পতাকা অর্ধনমিত। স্বস্তিময় স্বাধীনতা নয়; যেন অন্ধ পাখির বিলাপে মনকে অবদমন করতে বাধ্য সবাই।
বিষণ্ণ গোলাপের মতো মলিনতায় নেমে আসা শীতল দীর্ঘশ্বাসে বাড়ে হৃদয়ের ঋণ।
সময়ের স্রোত কাটিয়ে ফিরি করোনাকালীন অতীতে। যখন চৈতন্যের যথোচিত ভয়াল এই জয়ের আরাধ্যেই মনকে মানিয়ে নিয়ে যথাসম্ভব ধীরে চলেছি আমরা। ঘরবন্দি উদাসীনতায় ভেবেছি, মূর্ছাতুর মনের খানাখন্দ সারাতে খাপছাড়া এ সময় খুব শীঘ্রই হয়ে উঠবে অমল চন্দনলিপ্ত। অতঃপর সকলের সাথে মিশে অপরূপ তালে হবে ভাবঘন আলিঙ্গন।
আশা আর ভালোবাসায় কনে দেখা আলোর মতো সম্মুখে দাঁড়ায় কবি মহাদেব সাহার লাইনগুলো—
“ফুলের পাশেই আছে অজস্র কাঁটার পথ, এই তো জীবন
নিখুঁত নিটোল কোনো মুহূর্ত পাবো না,
এখন বুঝেছি আমি
এভাবেই সাজাতে হবে অপূর্ণ সুন্দর;
একেবারে মনোরম জলবায়ু পাবো না কখনো
থাকবে কুয়াশা-মেঘ, ঝড়ের আভাস
কখনো দুলবে ভেলা
কখনো বিরুদ্ধ স্রোতে দিতে হবে
সুদীর্ঘ সাঁতার,
কুয়াশা ও ঝড়ের মাঝেই
শীতগ্রীষ্মে বেয়ে যেতে হবে এই তরী;
যতোই ভাবি না কেন
সম্পূর্ণ উজ্জ্বল কোনো সুসময় পেলে
ফলাবো সোনালি ধান্য,
সম্পন্ন করবো বসে শ্রেষ্ঠ কাজগুলি-
কিন্তু এমন নিটোল কোনো জীবন পাবো না।”
লেখালেখির উৎকর্ষ সাধনে বরাবরের মতোই আসরে উপস্থিত গুরুজনদের জ্ঞানগর্ভ আলোকপাত ছিল আমাদের জন্য অমূল্য পারিতোষিক।
দূর হোক ঠোকরানো এ প্রহর,
স্বস্তির স্বপ্নকলি মেলুক ডানা শারদ রোদ্দুরে, সে প্রত্যাশায়…
আগামী পৃথিবী হোক কবিতার মতোই অনুপম!