সুমন, সুনীল,সৈয়দ,হুমায়ূন মে কোন গুরু সম্পর্কে বলা কটূসত্যকথা কোন শিষ্যই বরদাস্ত করে না – তসলিমা নাসরিন
বাংলায় গুরুশিষ্যের পরম্পরা। গুরু যতই অন্যায়-অনাচার করুক, শিষ্যরা মুখ বুজে মেনে নেয়। তারা মৃত্যুকে বরণ করে নেবে, কিন্তু গুরুর দোষ ধরিয়ে দেবে না। গুরু কোনও দোষ করতে পারে না, গুরুর সব ভালো, গুরুই ভগবান। এভাবেই শিষ্যদের মগজধোলাই হয়। এ কারণেই পীর আর বাবার ছড়াছড়ি বাংলায়। শিষ্যরা ঠকে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, তারপরও টনক নড়ে না।
শুধু ধর্মগুরু নয়, এ অঞ্চলে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীগুরুও আছে। ধনী আর বিখ্যাত লোকদেরও গুরু মানা হয়। তাদেরও একই রকম পুজো করা হয়, ভগবানকে যেমন করা হয়। তাদেরও সাত খুন মাফ করে দেওয়া হয়। সারা পৃথিবীতে মীটু আন্দোলনের জালে অনেকে ধরা পড়লেও, এই বাংলায় গুরু সম্প্রদায়ের ধর্ষক আর যৌনহেনস্থাকারিরা বহাল তবিয়তে বাস করতে পারে।
আপাদমস্তক বদমাশ লোকেরাও ভালো কবিতা লিখতে পারে, নাটক লিখতে পারে, অভিনয় করতে পারে, গান গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে। মুশকিল হলো, সুমনগুরু খিস্তি করলেও শিষ্যদের কানে তা মধুর শোনায়, যেহেতু এককালে তিনি ভালো গান করতেন। সুনীলগুরুর যৌনহেনস্থা নিয়ে কোনও ভিকটিম মুখ খুললে সঙ্গে সঙ্গে শিষ্যরা দু’ঘা দিয়ে দেয়। সৈয়দগুরুর পারভারসানের কথা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হুমায়ূনগুরুর অনৈতিকতার কথা কেউ উচ্চারণ করলে তার জ্যান্ত কবর দিয়ে দেয় শিষ্যরা। এই চলছে। নারীগুরুও আছেন। তবে তা রাষ্ট্রের বা রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের সম্পর্কে কোনও কটূসত্যকথা কোনও শিষ্যই বরদাস্ত করে না। এখনও শিল্প সাহিত্যের জগতে নারীদের গুরু বলে মানার চল শুরু হয়নি। যতদিন পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কার, ততদিন শুরু হবেও না।
কোনও লেখক বা গায়কের লেখা বা গান যদি ভালো লাগে, তাহলে বলুন তাদের লেখা বা গান ভালো লাগে। আর তাদের যৌন হয়রানি, বদমাইশি, স্বার্থপরতা, অসভ্যতা,কূপমণ্ডুকতা, ক্ষুদ্রতা, নৃশংসতা ভালো না লাগলে তা বলুন। কারও গান ভালো লাগলে তার গু-গোবরও কেন ভালো লাগতে হবে? একটি মানুষের ভালো এবং মন্দ দুই দিকই থাকতে পারে। মানুষকে গুরু নয়, মানুষ হিসেবে দেখুন।
ওদিকে আবার কোনও নারী-লেখককে যেহেতু গুরু বলে মানার নিয়ম নেই, নারী-লেখকদের গুণগুলোকে গু -গোবর বলে প্রচার করে পুরুষতান্ত্রিক লোকেরা। তাদের শত্রু যদি থাকে শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ, তাহলে বাকি ০.০১ ভাগ যদি বন্ধু, তাহলে বারবার ওই ০.০১ ভাগকে সতর্ক করে দেওয়া হয়, যেন তারা আবার ভুল করে শিষ্য না হয়ে যায়। নারী-লেখকটিকে যেন গুরু ভেবে না ফেলে। ফেললে সাড়ে সব্বনাশ।
সূত্র- মূল লেখা তসলিমা নাসরিনের ফেসবুক পোস্ট থেকে।