◼মগজে নেমেছে র্যাফ আর এক অপূর্ণ খাণ্ডবদাহ (মুক্তগদ্য)◼️
সঙ্গত কারণ ছিল বাড়ি না ফেরার, তাই আজ
শহরের তিরস্কার ফেলে এই বনে পালিয়েছি।
আমোদ যতই হোক পিছনে এসেছে পিছু-টান,
গাছের সংসার ছুঁয়ে দেখি, ওরা ভাল আছে কি না।
একটি গাছের মেয়ে চুড়ো করে গুঁজেছিল ফুল
একটি গাছের ছেলে আলগোছে ছুঁল ওর বাহু
পাতার সবুজ গন্ধ, সারাদিন ছুঁই-ছুঁই রোদ,
ও বন, তোমার কোলে শোব নাকি দু’এক মিনিট?
কী কথা ফাগুন কয়, বনময় শিকড় বাকল,
ঝুরু ঝুরু ঝরা ফুল কোকিলের অন্যমনা কুহু
শিকড় ডোবানো জলে জলচর দু’জন ডাহুক
সঙ্গত জবাবদিহি বাড়ি না ফেরার, তাই আজ
দুটি অ-পলক ফুল দিয়ে গেছে গাছের সমাজ।
— চন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়
◼️ক. ঘুমন্ত বালিশের হত্যারহস্য
◼️১.
খুলির ভিতর বীজ , সার ও উপযুক্ত জল। আরও কিছু কিছু , প্রয়োজনে। কিছুদিন পর বীজ থেকে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-জৈন, কিংবা দলিতেরা দলে-দলে অবশেষে বুদ্ধম শরণম…। এটা ভাল, তবে তার চেয়ে ভাল বীজ থেকে একটা বড় গাছ হোক, গাছে অজস্র পাতা হোক, ফুল হোক, ফল হোক, পাখিরাও আসুক ঝাঁকে-ঝাঁকে। গাছেদের এখনও কোনও মন্দির-মসজিদ নেই। গোটা আকাশ ও পৃথিবীটাই ওদের তীর্থস্থান। ধার্মিকেরা আজকাল খাণ্ডবদাহ-নৃত্যে। অরণ্যদেশে শাখাপ্রশাখাভর্তি নীল যোনি ও যৌনকেশ। স্তন-নিতম্ব-নাভিমূল আরও ফুট মেপে বিস্তর মাংসাশী আয়োজন। হাততালিও দিচ্ছে কেউ কেউ। তারাও তো ধম্মকম্ম করে। এক-এক করে পৃথিবীটা ধার্মিকে ভরে গেল। খুলিতেও। গাছেদের তীর্থস্থানে এভাবেই পটি করে দিল ঘোর ধার্মিকেরাই ।
◼️২.
স্মার্টনেসের জন্য স্মার্টফোনই যথেষ্ট। একটা কিনেও ফেললাম। বাবা বলল, দেব না। আমি বললাম , আমি না একা? আমাকে ভয় পাও! পেলও। ফেসবুকে পরদিন নিজেকে বেতাজ বাদশা ঘোষণা করলাম। বিস্তারিত ঝড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে নিজের ছায়ার সঙ্গে তুললাম কয়েকটি ঝকঝকে সেলফি। কেউ কেউ মেনে নিল এইসব বাদশাহী ফ্লু। কেউ আবার মানল না কিছুতেই। যারা মানল তাদের জন্য সাড়ে-তিন মিনিটের হামাগুড়ি ও একঝাঁক উড়ন্ত চুমু। আর মানল না যারা, তাদের খিস্তোলাম ওম শান্তি দু-বেলা , নিয়ম করে রোজ। বললাম,
‘অ’-এ অজগরটি আসছে ঘরে।
‘আ’-এ আম-আদমি খাবে পরে।
‘ই’-তে ইঁদুরছানা ঘরে ঘরে।
‘ঈ’-তে ঈগল খাবে পেটটি পুরে।
প্রচুর লাইক-কমেন্ট এবং ওয়াহ্ ওয়াহ্… !
স্মার্ট হবার জন্য এখন ইঁদুরছানারা ছুটছে বাবাদের কাছেই ।
◼️৩.
প্রেম ও যৌনতা ঠিকঠাক উপলব্ধি করার জন্য পণ্ডিত বাৎস্যায়নের কাছে গেলাম। প্রাজ্ঞ আমাকে অঙ্ক শেখালেন। শিখলাম, ভুলেও গেলাম।শীঘ্রপতন বিষয়ে গ্যালিলিও ও নিউটনের কাছে গেলাম। তাঁরা ডানকান ম্যাকডুগালের একুশ গ্রামের গূঢ় তত্ত্ব বোঝালেন ভারী চমৎকার। বোঝালেন পোষাপাখি ফুস করে উড়ে যাবার আগে ও পরে কতগুলো পালক অক্ষত রেখেছিলাম দুটি ডানায়। শিখলাম, ভুলেও গেলাম। সানি লিওনের কাছে গেলাম অরগ্যাজম বুঝতে। আড়াই ঘণ্টা ধরে দিদি যোগ-প্রাণায়াম শেখালেন, শেখালেন ডান-বাম ‘হা-রে-রে-রে’ ও মধ্যবর্তী ঝপাং। শিখলাম, ভুলেও গেলাম। এরপর বর্ষা এলেই হট ফেবারিট রবিনার কাছে প্যারাসিটামল রাতেই ছুটলাম। ‘টিপটিপ বর্ষা পানি’ চালিয়ে তুমুল নাচ শুরু হল খোলা ছাদে। রাত্রিমেঘ নেমে এল ডিশ-অ্যান্টেনায়। বৃষ্টিও। ভিজে গেল রবিনার হলদে শিফন শাড়ি। ভিজল না চাষের জমি ও একটি বাঁশুরিয়া মন। আত্ম-মৃত্যু জেনেও স্রেফ এক সেলফির লোভে কার্নিশে কিছুক্ষণ অক্ষয়কুমার সাজলাম শেষে। অমনি ছাদ থেকে পড়ে গেল রবিনা!
◼️৪.
ঘুম ভাঙল রাতে। ভাবলাম স্বপ্নে যে দীর্ঘ গদ্যটা লিখছিলাম, সেটা পড়েই আনন্দে হাততালি দিচ্ছে মোমো। ধুর, ও মশা মারছে সেই থেকে! পেঁচার থেকেও সুতীক্ষ্ণ নজরে এক-একটা রক্তচোষাকে ধরে যমের দক্ষিণদূয়ারে চালান করে দিল মোমো । রাতে আর ঘুম না-আসাতে ছাদে এলাম একা । এখানেই কিছু আগে রবিনার সঙ্গে উদ্দাম নেচেছি খুব। ভোঁকাট্টা ঘুড়ি হয়ে রবিনা এখন ঝুলে আছে অন্য ডালে, মৃদু হাওয়াতেও দুলছে তাঁর মেধাহীন হলদে শিফন ।
ডাল? কাল সকালেই যে সাফ! কী হবে রবিনার? কার্নিশহীন ছাদ বা খাতা থেকে এক-একজন রবিনা কীভাবে গুম হয়ে যাচ্ছে!
রবিনাও কি রক্তচোষে, না অক্ষয়বাবুরা লেঙ্গি মারে খুব?
যাইহোক, নিজেকে ব্ল্যাকবেল্টার ভাবলে, অক্ষয়কুমার ভাবলে সিনা ছাপ্পানো হয়ে যায় মিঁত্রোওওওওওওওও…
◼️৫
ট্রেনটা শাঁ শাঁ করে চাঁদপাড়ার দিকে ছুটে গেল। একটু আগেই ঘোষণা হয়েছিল, যাবে। শুনেছিলাম ছাদে বসে। নেহাত ভোর বলেই এই শুনতে পাওয়া আসলে। এত এত পাখি ডাকছে শাখায়, বাতাসে এত ঘুমন্ত পাতার হাসি…এত নীল তারাদের নীরব কোলাহল আকাশে… এর ফাঁকেই… কী আশ্চর্য! কিছুপর ঘুম ভাঙবে শহরের। আমাদের হা-শহুরে চিৎকার লোপাট করবে তখন সমস্ত অরণ্য-সংবেদ।
ধানখেতের ভিতর দিয়ে চলে যায় সবুজ ট্রেন।
ট্রেন নয়, যেন এক সুবিশাল শিরীষগাছ। ওর গায়ে পাখির গান, চিবুকে কাঁচাধানের গন্ধ, চাকায় নিমফুলের আদর, জানলায় মেঘরেণুর নীল ওড়না। কয়েকটা স্টেশান পার হতেই দুঃশাসনের হাত, দাঁত ও প্রত্যায়িত নখগুচ্ছের সক্রিয়তায় অবশেষে আজানু ডলার-মালা নিয়ে শেয়ালদহ ঢুকে যাচ্ছে এক উলঙ্গ পাগলি। পালকহীন শিরীষ-যোনিতে তখন খান্ডবদাহ ও নাগরিক ইচ্ছে-অনিচ্ছের শিশ্নসুখ। জরায়ুমুখে আহা কী উল্লাস ও ডলার-বমন! ডলারই ওম শান্তি, ডলারই শুধু সুখে মারিতাং জগত।
জরায়ুতে সন্তান নিয়ে অবশেষে ট্রেনে ফিরবে শেষ রাতে একা। আমরা কি তখন কাঁথা সরিয়ে কোলে তুলে নেব না সে-ভোর?
◼️৬
আদালত বলছে, আপাতত থামো। তবু গাছেদের কোমরে দড়ি, আজও! ভাবছি এবার সব গাছ উপড়ে বসন্তোৎসব করব। পঁচিশে বৈশাখও। নাচের জন্য হেমা-রেখা-জয়া ও সুষমা তো আছেই। আছে তাদের সবার প্রিয় নিরমা ওয়াশিং পাউডার। আর ডাক্তারবাবু যাদের রোজ দেড় মাইল হাঁটতে বলেছেন, তাদেরই শুধু বেছে-বেছে ডেকে নেব এই শোভাযাত্রায়।
◼️◼️খ. এক নিপাট আত্মহত্যার পর ◼️◼️
বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল আবার ।
বৃষ্টি নয়, এই সাতসকালে ট্যাঙ্ক উপচে মিহি জল নামছে মাটিতে। তবু এক ঘোরের ভিতর ছিলাম বেশ। হৃদয় মেনেছিল বৃষ্টিকেই, স্বপ্নের মতো, স্বপ্নের অগুন্তি পাতাঝরা রাতে। কিংবা মৃদু অপরাহ্ণে তুমি-আমি ও কিছু মুখরা পাখি। বাদামি পাতার ’পর তোমার পায়ের ছাপ। পাতাভাঙা মিঞামল্লার নগ্ন নূপুর-তলে। বৃষ্টি নয়, এই বর্ষাধ্বনির মাঝেই মেলে ধরেছ পাখিমুখ। বাঁ-হাতের গোলাপি আঙুলগুলো আমার মুঠোয় কুঁড়ি হয়ে আছে এখনও।
কাল চৈত্রশেষের জোছনা বাঁ-বৃন্তের নিকট রক্তবর্ণ তিলের মতো সৎ ও সাহসী, হাওয়া রাতপ্রশ্বাসের মতো নেশাতুর, দৃশ্য অরণ্যসমুদ্রের মতো যৌনগন্ধী। ঝিঁঝি ডাকছিল বেশ। ব্যাঙ ডাকছিল খুব। জল থেকে ঘোড়াটা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল চাঁদের দিকে মুখ করে। ঘোড়া নয়, গাছ। গাছেদের মৌনমিছিল। শরীর থেকে তখনও ঝড়ছে হ্রেষা, জোছনা, প্রেম ও বৃষ্টি।
আবারও বৃষ্টির কথা হল! অথচ বৃষ্টি নাম্নী কেউ কখনও আসেনি এ-পথে। শৈশবে বৃষ্টিতে ভিজলেই ধুম জ্বর। স্কুল বন্ধ, আলসের বিলে যাওয়াও। এমনকি মাছধরা-ঘুড়িওড়ানো —সব! জানলা দিয়ে শুধু চেয়ে দেখা ছুটে যেতে তাঁকে অন্য হাত ধরে। আমি তো তাঁর আঙুল ছুঁয়েছি কত সেইসব আধভাঙা স্বপ্নের ভিতর ! কপাল ছুঁয়ে চুমু খেয়েছি লুকিয়ে। ভীষণ ঘন জ্বরের ভিতর ডুবতে-ডুবতে সেই আঙুল ধরেই উঠে এসেছি অনন্ত নীপবনে। সেখানে ‘হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে’, কেবল আমি-ই দাঁড়িয়ে একা। বুদবুদ-শরীর নিয়ে শুনছি তখন নঞর্থক ক্ষুরধ্বনি।
সাইরেনটা আজও বেজে উঠল। রেবাদির শিশুগাছে পাখিটা ডাকছে তখন থেকে, যেন তোমার মুখের ভিতর জল নাচছে অবিরাম। বাতাস ছুটে এল তোমার নীল ওড়নায়, অথচ দেখো তোমাকে ওড়নায় দেখিনি কখনও।
পাখিটা ডাকছে এখনও। ট্রেনের জানলা থেকে ওড়নাটা এসে পড়ল কৃষ্ণচূড়ার ’পর। লজ্জাবনত দো-রঙিন ঘুড়ি সহসা বাতাস পেয়ে প্রিয় শাখাপাশ থেকে ছুটে যেতে চাইছে ভীষণ।
ডুবজোছনা থেকে ফিরে জেনেছিলাম কাল গাছেদের জড়িয়ে ধরে হাউহাউ বৃষ্টি নামত একদিন তোমার শরীর জুরে। সে-শব্দে ঘুম ভাঙত পাখিদের। সে-শব্দে বোবা গাছেরা আরও জোরে শাখা নেড়ে বলতে চাইত কীসব। তুমি হয়তো বুঝতে সেই মরু-হাহাকার।
বেলা বাড়ছে। জানলা দিয়ে রেবাদির শিশুগাছ পেরিয়ে-আসা দস্যিরোদ্দুর লাল চেয়ারের ’পর লাফাচ্ছে খুব। ফোনটা বেজে কেটেও গেল। পাখিটা এখনও ডেকে যাচ্ছে। তোমার মুখের ভিতর জল, এখনও। কৃষ্ণচূড়ার পাশে আর-একটা পাখি ডেকে উঠল। কী তার নাম? আমি কি এত এত পাখি চিনি, কিংবা তাদের অজস্র গান? শুধু বুঝি একদিন পাখি ডেকেছিল খুব কোনও এক ঘুমন্ত ভোরে। হৃদয়ে?
ওই দেখো আর-একটা পাখি ডেকে উঠল ধানখেতের পাশে। মাঝে-মাঝেই আমগাছের নীচ থেকে ডেকে উঠছে ঝুঁটিমোরগ, যেন রেগে যাচ্ছে খুব, কিংবা চড়া গলায় শাসাচ্ছে অন্যদের। কিনুদির কলে কাপড় কাঁচছে কেউ। পটাশ-পটাশ! চটাশ চটাশ! কাঁচছে তো না, ধরে ধরে উদোম পেটাচ্ছে চাতালে। সব ময়লারাগ দূর হয়ে যাবে এবার। জীবনের সব ময়লারাগ!
এইসব লেখা একদম পছন্দ নয় তোমার। তাতে কি? আমি তো স্বার্থপরের মতো লিখে যাচ্ছি আমার অনিদ্রা। নিজেকে হাসাতে, কাঁদাতে। নিজের জন্যই এইসব শব্দ–নৈঃশব্দ্যের অনন্ত ট্রাপিজ। তুমি চাইছ আমি লিখি বনসাই, লিখি চকচকে যোনিদ্বার, লিখি আরও কিছু স্পষ্ট। অথচ লিখে যাচ্ছি শিরীষকথন। বলছি , যোনির ভিতরও মন্দির পাওয়া যাবে খুঁজে একদিন যদি এক চিলতে মেঘের মতো হাসতে পারো কখনও, গোধূলিবেলায় শিরীষপাতার মতো কারও কাঁধে মাথা রেখে শুনতে পারো আর-একটা গ্রামীনবিবির ছড়া। ছায়াহীন পথে আজ বড় দুর্গন্ধ। চলো সকল আইটেম-সং ছেড়ে ধবধবে কবিতা ছেড়ে আবার আমরা শুকনো পাতার ’পর বসে পাঁচালি পড়ি কিছুক্ষণ ।
পাখিটা বুঝি খেপেছে খুব। কিছুক্ষণ চুপটি মেরে বসেছিল সবুজ রোদ্দুরে। এবার কুহু, আরও জোরে! পাখিদের ডাকে কি বৃষ্টি নামে কখনও?
বৃষ্টির শব্দে ট্রেনগুলো হারিয়ে যায় অন্ধগুহায়। তুমিও ফিরে যাবে ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে। পাখিটাও। রেবাদির শিশুগাছ খুন হয়ে যাবে দিনেদুপুরে। মোরগটাকে খেয়ে ফেলবে কেউ। তার কিছু আগেও সে ডাকবে ‘আয় আয় টি টি’ বলে প্রিয় কাউকে। কৃষ্ণচূড়া উপড়ে হবে ধর্মের ওয়াচটাওয়ার। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে আমাদের আপাত নীল ক্ষত। বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে সাফ পাতাদের মন্দিরগুচ্ছ। তবু বৃষ্টিতেই ঘুম ভাঙবে আবার। বৃষ্টিতেই স্বপ্ন নেমে আসবে ঝিরঝির ঝিরঝির।
সেকালের সাদাকালো টিভির মতো পরদা জুরে শুধুই বৃষ্টি।