বিভাগ- গল্প
গল্প-আসামী
রত্না চক্রবর্তী
২০.১.২১
অনিমেষ ঘুমের ওষুধের শিশিটা হাতে তুলে নিল। একটা একটা করে বড়ি বার করে রাখল প্লেটটায়। ঠিক উনত্রিশটা।দেওয়ালে সাজানো মা বাবা আর তার একসঙ্গে নৈনিতালে তোলা ফোটাটার দিকে তাকিয়ে থাকে অনি। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে।একবার অস্ফুট স্বরে বলে-“সরি বাপী মা।এছাড়া আর কোন….”
অনির বিয়ে হয়েছে চার মাস আগে। অনি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। পড়াশুনায় ভালো ছিল বরাবর। বাবার আদরের। আর মায়ের একটু বেশীই আহ্লাদে। মায়ের একটা নার্ভের সমস্যা থাকার জন্য চট করে রেগে যায়। আর সেই রাগ বেশ বাড়াবাড়ি রকমেরই হয়। তখন একমাত্র অনিই পারে সেই রাগ থামাতে। অনি অরুণাদেবীর চোখের মণি। অনি ভালো চাকরীও করে।
চার মাস আগে অনেক দেখা শোনা করে প্রীতির সাথে বিয়ে দেন অরুণাদেবীরা অনির। প্রীতিকে ভালো লেগেছিল অনির। কম কথা বলে। লাজুক মনে হয়েছিল।ছাব্বিশ বছরের জীবনে মেয়েবন্ধু কয়েকজন থাকলেও প্রেমটেম ছিল না অনির। আর মা একটু অধৈর্য স্বভাবের মহিলা বলে পাছে সংসারে অশান্তি হয় প্রেমট্রেমের কাছ থেকে দূরেই থেকেছে। মা যা ঠিক করবে সেটাই ভালো হবে। তাই প্রীতিকে দেখে সে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।বিয়ের আগে বার তিন চারেক দেখা হয়েছে। কথা প্রায় হয়ই নি। তার অন্য বন্ধুদের কাছে শুনেছে হবু বৌএর সাথে তারা ফোনে গল্প করত। কিন্তু লাজুক মেয়েটার থেকে ফোন নম্বর চাওয়ার সুযোগ হয় নি অনির। তাছাড়া সে ভেবেছে আর কয়েকদিন পর যে এবাড়িতেই আসবে তার সঙ্গে তখনই নয় আলাপ করা যাবে। তার মধ্যেও একটা চার্ম আছে। বিয়ে হয়েছে। প্রীতির মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না। শুধু বড় বেশী চুপচাপ। হাসিতে যেন প্রাণ নেই। স্বামীস্ত্রীর একান্ত সময়গুলোতেও যেন সেই তীব্র সাড়া নেই। অনি ভেবেছে মা বাবাকে ছেড়ে একজন অপরিচিতের সাথে এসেছে।মানিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক হতে সময় তো লাগবেই।
ওরা হনিমুনেও গিয়েছিল। কিন্তু হনিমুনে তোলা কোন ছবিতেই প্রীতিকে প্রাণখুলে হাসতে দেখা যায় নি। একটা যেন অদ্ভুত বিষণ্ণতা। অনি ভেবেছে একবার প্রশ্ন করবে প্রীতির এই বিয়েতে মত ছিল না কিনা। কিন্তু নিজে থেকে প্রীতি এত কম কথা বলে যে ঠিক জিজ্ঞেস করে উঠতে পারে নি।
তারপর বিয়ের সাড়ে তিনমাসের মাথায় সেই ভয়ানক সন্ধ্যেটা। অনি অফিস থেকে ফেরার সময় নিয়ম করে প্রীতিকে ফোন করত। সেদিনও করেছিল। প্রীতি ফোন ধরে নি। অনি ভেবেছিল হয়ত ব্যস্ত আছে। মা বাপী ডাইনিঙে বসে চা খাচ্ছিল ।অনি নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। অনেক ডাকাডাকি করেও যখন প্রীতি খুলল না তখন চিন্তায় পড়ল সবাই।মেয়েটা কি ভিতরে অসুস্থ হয়ে পড়েছে?শেষে দরজা ভাঙা হল। আর সেই ভয়ংকর দৃশ্য। সিলিং থেকে ঝুলছে প্রীতি। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। জিভ ঝুলে পড়েছে। পাথর হয়ে গিয়েছিল অনি।বুঝতে পারেনি কেন কেন কেন…
কিন্তু পাড়ার লোক আত্মীয় স্বজনেরা বুঝে গিয়েছিল। নিজেদের নিজেদের মত করে তারা ঠিক বুঝে নিয়েছিল কেন প্রীতিকে চলে যেতে হয়েছে। পাড়ার অনেকেই বুঝে গিয়েছিল শ্বাশুড়ীর অত্যাচারে মাত্র সাড়ে তিনমাসের বিবাহিত জীবনেই প্রীতিকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল। অনেকে আবার বুঝতে পেরেছিল অনির প্রাকবিবাহ কোন সম্পর্কের জেরেই মেয়েটাকে নিজের জীবন শেষ করে দিতে হল। অনিদের আত্মীয়ের অনেকেই এমন কথাও ভাবতে শুরু করেছিল যে বিয়ের রাতেই অনির কোন শারীরিক সমস্যা টের পেয়ে যায় প্রীতি।
তাই তাকে এমন মনমরা দেখাত। অফিসের এক কলিগ তো এসে বলেই ফেলল-” কি করবেন মি:রায়,আপনার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী এরকম একটা কান্ড করে বসলেন। বোকা মেয়ে। যদি বনিবনা নাই হয়ে থাকে তবে তো ডিভোর্সের রাস্তা খোলাই ছিল। অন্য কোন রকম সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যেত। ” কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে অনির।অফিসে যেতে ইচ্ছে করে না।কেউ হয়ত সামনে বলে না। কিন্তু কথাদের গায়ে ডানা লাগানো আছে। বিশেষত এইসব কথাদের। কি করে কে জানে ঠিক কানে এসে যায়। অনেকে ভাবছে অনি পুরুষত্বহীন নয়ত?এত বছর বয়স অবধি একটাও প্রেম হল না কেন তবে? হয়ত সেটা জেনেই প্রীতি…. শুধু কোন একিউজ করে না প্রীতির বাড়ির লোক। খুব কান্না কাটি করে। কিন্তু একবারের জন্য দায়ী করে না নতুন জামাই বা তার পরিবারকে।
পুলিশ কাছারীতেও এগোতে চায় না। অথচ আক্রোশটা তো ওদেরই সবচেয়ে বেশী হবার কথা! প্রীতির মা আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন।তিনি বোধহয় মনে মনে জানতেন এমনটা হতেই পারে। কিন্তু সত্যি তো কিছু করার ছিল না তার। নিজের জাঠতুতো দাদাকে প্রীতির সাতের বছর বয়েসে প্রথম দেখে। প্রীতির জ্যাঠা বিদেশে থাকতেন। রিটায়ার করে দেশে ফেরেন। প্রীতি ওই বয়েসের নাবোধ মেয়েটা বছরদুয়েকের বড় নিজের জাঠতুতো দাদার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। ঘূণাক্ষরেও যদি তখন টের পেতেন তারা, হয়ত তখনই দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতেন। কিন্তু যখন জানলেন তখন দিন অনেক গড়িয়ে গেছে। প্রীতির বাবার মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেল। প্রীতি বিয়ে করতেই চায়নি। কিন্তু তার জন্য তার বাবার এই অবস্থা দেখে আশ্চর্য রকম চুপ করে যায় সে। বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের পর দুমাস কেটে যেতে মনে মনে স্বস্তি পেয়েছিল প্রীতির মা।
হয়ত ছোটবেলার ভুলটা শুধরে সংসারী হল তার মেয়ে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রভাস মানে প্রীতির জাঠতুতো দাদার বিয়ে স্থির হল। সেই খবরটা পাওয়ার পরই…. অনি মুখ দেখাতে পারবে না কাউকে। বিনা দোষে সে ভালো ছেলে থেকে, ভালো স্বামী থেকে আসামী হয়ে গেছে। লোকের কথায় রোজ একটু একটু করে মরে যাচ্ছে সে।আর তার জন্য তার মা বাবা। সমাজে তারা যেন সাংঘাতিক ঘৃণ্য জীব। না এভাবে একটা অপমানের জীবন বয়ে নিয়ে যাবার চেয়ে একবারে শেষ হয়ে যাওয়া অনেক ভালো। সে মরে গেলেই আসামীর কাঠগড়া থেকে তার বাবা মা নেমে যাবে। অন্য দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখবে ঘটনাকে। জীবনের পরে কি আছে অনি জানে না। কিন্তু যদি সেখানে প্রীতির দেখা মেলে, তবে একবার সে অন্তত জিজ্ঞেস করবে-“কেন? কেন? কেন?”