Homeমুক্তমতপ্রকৃত এক লেখকদর্শন: হোসেনউদ্দীন হোসেন - জাকির তালুকদার

প্রকৃত এক লেখকদর্শন: হোসেনউদ্দীন হোসেন – জাকির তালুকদার

প্রকৃত এক লেখকদর্শন: হোসেনউদ্দীন হোসেন

– জাকির তালুকদার

‘আমি চাইনি আমাকে কেউ কোনো দলের দালাল ভাবুক।
কোনো আদর্শহীন কবি বা লেখকগোষ্ঠীর সদস্য ভাবুক।
কোনো পত্রিকা বা প্রকাশনীর অনুগ্রহভাজন ভাবুক।’
সুশ্রাব্য যশুরে আঞ্চলিক ভাষায় অনর্গল কথা বলছিলেন হোসেনউদ্দীন হোসেন। খাবারের ছোট্ট টেবিলে আমাদের জন্য রাখা হয়েছে খেজুর রসের পিঠা। হোসেনউদ্দীন হোসেনের বাড়িতে। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা সদরে তাঁর ছিমছাম দালান-বাড়ি, শানবাঁধানো পুকুর, বাড়ির পাশে তিনদিকে সবজিবাগান, ফুলের বাগান। পুকুরের পাশে একটি টংঘর। সেখানে মানুষের সাথে বিকালে এলাকার সবধরনের মানুষের সাথে নিয়মিত গল্পগাছা করেন তিনি। স্ত্রী, পুত্র-জামাই, কন্যা-বধূ, আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে পরিপূর্ণ আনন্দমুখর পরিবার। এমন স্বর্গতুল্য জায়গা ছেড়ে তিনি কোন দুঃখে নরক হয়ে ওঠা রাজধানীতে বাস করতে আসবেন? যেহেতু তিনি অনেক আগেই জেনেছেন যে ভালো লেখক বা কবি হবার জন্য রাজধানীতে বসবাস করা কোনো বাধ্যতামূলক শর্ত নয়।

দেশের এবং বিদেশের অনেক বড় লেখকের একটি তালিকা তিনি মুখে মুখে বলে গেলেন, যারা কোনোদিন নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি লেখালেখিতে সুবিধা হবে বলে। ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর ঢাকাতে গিয়েছিলেন। শহীদুল্লাহ কায়সার পরীক্ষা নিয়ে তাঁকে দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে চাকুরি দিয়েছিলেন। বেতন ছিল মাসে ৪২ টাকা। সাকুল্যে তিন বছর চাকুরি করেছিলেন তিনি। ঢাকাতে বসবাস সেই তিন বছরই। পিতার অনেক জায়গাজমি। তিনি চাইতেন সন্তান বাড়িতে থেকেই আরো পড়াশুনা করুক। জমি-জমা যা আছে তার দশভাগের একভাগ দেখাশোনা করলেও দিন কেটে যাবে রাজার হালে। তিনিও পিতার কথাই মেনে নিলেন। লেখালেখি করা এবং অবিরাম পড়া যে একে অন্যের পরিপূরক, তা তিনি অল্প বয়সেই জেনে গিয়েছিলেন। সব পড়তেন।

বাংলাভাষার সকল বড় লেখকের সব রচনাই পড়েছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেইসাথে বিদেশি সাহিত্যও। আমাদের দেশের উঠতি লেখকদের সাধারণ প্রবণতা তখন ইংরেজি সাহিত্য বেশি বেশি পড়া। সেসব তিনিও পড়েছেন। তবে তার চাইতে বেশি মনোযোগে পড়েছেন ফরাসি লেখকদের রচনা। আর পড়েছেন রুশসাহিত্য। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইংরেজদের ইতিহাস, আমেরিকার ইতিহাস। তাই কোন জাতির প্রবণতা কোন দিকে বেশি তা বুঝে নিতে তাঁর কষ্ট হয় না।

প্রথম দিকে কবিতাই লিখতেন। ‘সমকাল’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা যত্নের সাথে ছাপতেন সিকান্দর আবু জাফর। নির্মোহ সম্পাদক হিসাবে খ্যাতি ছিল তাঁর। সেইসময় ‘সমকাল’ পত্রিকায় লেখা কারো ছাপা হলে তিনি লেখক হিসাবে গৃহীত হতেন সবমহলে। হোসেনউদ্দীন হোসেনও হয়েছিলেন।

লেখকের জীবন মানেই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি চাওয়া। অ্যাডভেঞ্চার তো লেখকের রক্তে। তা হোসেনউদ্দীন হোসেনেরও পুরোমাত্রায় ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন বিশেষ গেরিলা ইউনিটে। প্রচণ্ড পরিশ্রম আর যোগ্যতা দেখিয়ে সর্ট কমিশন্ড অফিসার হয়েছিলেন। তবে বেশিদিন সেখানেও থাকেননি। দুই বছর পরেই পারিবারিক বিভিন্ন অসুবিধা দেখিয়ে চাকুরি ছাড়তে চাইলেন। তখন সেনাবাহিনীর চাকুরি ছাড়াটাও খুব সহজ ছিল না। নানা রকম তদন্ত আর জিজ্ঞাসাবাদের পর চাকুরি থেকে তিনি রেহাই পেলেন। তবে মুচলেকা দিতে হলো যে, দেশের প্রয়োজনে যখনই তাকে ডাকা হবে, তৎক্ষণাৎ-ই তাকে ফিরে এসে যোগ দিতে হবে সেনাবাহিনীতে।

যুদ্ধে যোগ তিনি দিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তানের পক্ষে নয়। যুদ্ধ করেছিলেন ১৯৭১ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। সরাসরি বা মুখোমুখি যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনি। আর সেনাবাহিনীতে পাওয়া গেরিলা ট্রেনিং বিশেষ কাজে লেগেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে গিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক ঘটনা শুনলাম তাঁর মুখে। কিছু কিছু লিখেছেন ‘রণক্ষেত্রে সারাবেলা’ গ্রন্থে। কিন্তু কোনো গ্রন্থে যা লেখেননি, সেকথা জানালেন আমাকে– ‘তারপরে তো যুদ্ধ শেষ হলো। আমরা অস্ত্র জমা দিয়ি ফিরলাম বাড়িত। কী করব, তাই ভাবছি। দেখলাম বাড়িঘর সব লুটপাট হয়ে গিইছে। কয়েকখান গরু ছিল, সেগুলো জবাই করে পাকবাহিনী আর রাজাকাররা ফিস্ট খেইয়েছে। তোমার ভাবির যে কয়খান গয়না ছিল সেগুলো বেচে একজোড়া বলদ কিনলাম। আর লাঙল। তারপরে নিজির হাতে চাষ করা শুরু করলাম জমি।… তারপরে আর কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করিনি আমি।’

আবার শুরু হলো লেখালেখি। ঝিকরগাছা তখন একেবারেই অজ পাড়া গাঁ। কিন্তু সেখানে বসেই ঢাকা থেকে ভিপি যোগে বই আনান। পড়েন। লেখেন। লেখার পরে ফ্রেশ কপি করে ডাকযোগে লেখা পাঠান বিভিন্ন পত্রিকায়। সব পত্রিকাতেই তাঁর লেখার চাহিদা। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি প্রবন্ধ, আলোচনাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। মানুষ যাদের কথা ভুলে যায়, অথচ যাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ভুলে গেলে নিজের এবং জাতির ক্ষতি হয়ে যায়, সেইসব ব্যক্তিত্বকে তুলে আনলেন বিভিন্ন লেখায়। এই পর্বে সম্পাদক হিসাবে তিনি বারবার উল্লেখ করেন দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবিবের নাম। কেন তিনি বিশিষ্ট? উত্তরে হোসেনউদ্দীন হোসেন বললেন– আমি যখনই লেখা পাঠাতাম, আহসান হাবিব সাহেব তখনই ছেপে দিতেন। একবার একখান লেখা পাঠালাম। কিন্তু তিনমাস ছয়মাস কেটে যায়, লেখাটা আর ছাপা হয় না। আমি লেখাটার বিষয়ে চিঠি লিখলাম।

আহসান হাবিব উত্তরে জানালেন, আমি ঢাকাতে গেলে যেন তার সাথে দেখা করি। তো আরো কয়েকমাস পরে ঢাকায় গিয়ে দৈনিক বাংলা অফিসে তার সাথে দেখা করলাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন, চায়ের অর্ডার দিলেন। তারপরে ড্রয়ার থেকে আমার সেই লেখাটা বের করলেন। বললেন, এই লেখাটা যদি ছাপা হয়, তাহলে আপনার সুনামের হানি ঘটবে। আপনার যেসব লেখা আমরা ছেপেছি সেগুলো নিয়ে সচেতন পাঠকমহলে আপনার সুনাম তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই লেখাটি তুলনামূলকভআবে দুর্বল। এটি ছাপলে আপনার ওপর পাঠকের আস্থা কমে যাবে। তারা ভাববে, আপনিও বোধহয় স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। এখন আপনি বলুন, এটা ছাপা কি উচিত হবে? আপনি ছাপতে চাইলে আমি ছাপব।
কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন স্মৃতিতে ডুবে গেলেন হোসেন ভাই– পাবা এখন এমন সম্পাদক? আছে কেউ? হবে কেউ কি আর কোনোদিন?
উত্তর দিই না।

নিজেই বললেন– আহসান হাবিব সাহেবের কবিতা নিয়ে আমি একখান পুরো বই লিখেছি। বাংলা একাডেমি থেকে বের হইছিল। নাম ‘ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবীব’।
এইটুকু বলে হেসে উঠলেন। বললেন– তারপর কী হলো জানো? যার বই বার হয় সে-ই আমার ঠিকানায় বই পাঠায়, চিঠি পাঠায় যাতে আমি তার বই নিয়েও লিখি।
তাহলে তো অনেক বইয়ের রিভিউ লিখতে হয়েছে আপনাকে!

আরে নাহ! মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন হোসেন ভাই– আমার ভালো না লাগলি লিখতে যাব কেন? আর কারো অনুরোধে আমি তো কখনোই কিছু লিখি নাই।

দুইদিন-দুইরাত অসংখ্য বিষয়ে কথা শুনেছি তাঁর। অকপট। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার– কারো নিন্দা করে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি।
সেইসময় তাঁর লেখক-কবি সাথীরাই তো পরবর্তী কয়েক দশক ধরে বাংলা একাডেমির সর্বেসর্বা ছিলেন। এখনো আছেন। তারা কি আপনাকে চিনতেন না ঠিকমতো?
চিনবে না ক্যান? সবাই যোগাযোগ রাখত আমার সাথে। বই পাঠাত। লেখা পাঠানোর অনুরোধ করত বাংলা একাডেমির পত্রিকাগুলোর জন্য।
তাহলে কেন তাঁরা পুরস্কার বা সম্মাননার সময় আপনার কথা তোলেননি?
তিনি নির্বিকার বললেন– সিডা আমি কেমন করি বলব! তারাই বলতি পারে বিষয়ডা কী।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments