অণুগল্প: কুমারী মা
কলমে; সুজিত ঘোষ
পাহাড়ী এলাকায় বসবাস অহনার এখানে সবাই তাঁতী, জেলে, শ্রমিক, চাষা-ভৃষারা ছাড়া এখানে মধ্যবিত্তদের বসবাসের সংখ্যা হাতে গোনা দু চার ঘরের। পাহাড়ী এলাকায় তেমন বসতি নেই এই গ্রামের সবাই ডাকাত আর বন্য প্রাণীদের ভয়ে জীবন যাপন করে। খেটে খাওয়া মানুষ মোতালেব বয়স পঞ্চাশ হলেও বলিষ্ঠ দেহ প্রচুর পরিশ্রম করে এখানো কারণ একমত মেয়ে অহনাকে লেখা পড়া করিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে হবে। অহনাও বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রতিদিন দুই মাইল হেঁটে স্কুলে যাতাযাত করে। লেখা পড়ায় বেশ ভালো অহনা। এবার এস এস সি পরীক্ষা দেবে কিন্তু সমস্যা হলো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ানোর জন্য দিতে পাড়েনি তার বাবা।
এর মধ্যে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী দের সচেতনতা মূলক জীবনযাপনের জন্য এগিয়ে আসে বেশ কিছু সংস্থা। এর মধ্যে মাসুদ নামের এক ভদ্রলোক দাত্বিয় পায় অহনাদের গ্রামের। মাসুদের ব্যবহার ভদ্রতায় সে হয়ে উঠে সকলের নয়নের মণি আস্থাভাজন।
অহনার বাবা মোতালেব মিয়া লজ্জা সরম ত্যাগ করে মাসুদকে বলে তার মেয়ে এবার পরীক্ষা দেবে তাকে একটু বাড়িতে এসে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। মাসুদ সাহেব ও রাজি হয়ে যায়। এভাবে অহনা আর মাসুদ সাহেবের পরিচয়। শিক্ষক আর ছাত্রীর সম্পর্ক এক সময় প্রেমের সম্পর্কে পরিণত হয়। অহনার পরীক্ষা শেষ তবুও মাসুদ সাহেবের অহনা দের বাড়িতে যাতাযাত ছিল সর্বক্ষণ।
এভাবে কেটে যায় ছয় মাস এবং মাসুদ সাহেবের যাওয়ার সময় চলে আসে কারণ এদের কাজ ছিল চুক্তি ভিত্তিক তাই যেতে হবে। মাসুদ অহনাকে তার চলে যাবার কথা বলে এবং আরো বলে আমি কিছু দিনের মধ্যেই এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। অহনা বলে তুমি সত্যিই আসবে তো না এলেও বলো কারণ তোমার সন্তান আমার গর্ভে তুমি না এলে আমার মৃত্যু ছাড়া কোন উপায় নেই। মাসুদ অহনাকে তাদের ভালোবাসার দিব্বি দিয়ে বলে আমি আসবো আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না অহনা এই বলে মাসুদ চলে যায় অহনার কাছ থেকে।
ভালোবাসার অর্থ কি যার জীবনে ভালবাসা আসেনি সে জানবে না এর মহত্ত্ব আর উদারতার কথা। ভালোবেসে অহনা সর্বস্বন্ত আজ তার আর কিছুই নেই তার জীবনে সামনে শুধু দুর্নাম। পুরুষ শাসিত এই সমাজে নারীরা ভোগের সামগ্রী হয়ে উঠেছে কিছু পুরুষের কাছে। বর্ষার একটানা বিরামহীন বৃষ্টির রাতে মাসুদের স্মৃতিগুলো অহনাকে একাকীত্ব কাঁটায়। চার দেয়ালের ভিতর ঘন্টার পড় ঘন্টা বন্দি দশায় বসে আর সময় কাটছে না অহনার। ভালোবাসার ভীষণ জ্বরে ভুগে প্রলাপ বকলে লোক উপহাস করবে, পাগল ভাববে যারা এই জ্বরে কেঁপে মরবে শুধু তারাই বুঝবে এটা বকায় কতখানি।
পরিবর্তনশীল মানুষ তাই বলে মানুষ এতখানি? এইতো সেই মাসুদ যে কিনা ফিরে আসার কথা অথচ এখনো আসেনি। আর আসবে বলে মনে হয় না অহনার। ততপড় অহনা তার মাকে সব বলে কিন্তু সমস্যা এতদিনে অহনা আট মাসের গর্ভবতী। লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারবে না অহনার মা। অহনার মা অহনার বাবাকে তার মেয়ের বিষয়ে সব বলে এবং তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের আত্মীয় অহনার খালা থাকেন শহরে অহনাকে শহরে পাঠিয়ে দিবে।এবং অহনার বাচ্চা হওয়ার পড়ে কোন এতিম খানায় দিয়ে দিবে।
বিষয়টি অহনা জানতে পেরে তার বাবা মাকে বলে আমি আমার বাচ্চাকে কোথাও দিব না। কারণ এই বাচ্চা আমাদের ভালবাসার স্মৃতি চিহ্ন তাই এই বাচ্চা আমার কাছে থাকবে, আমি মানুষ করবো যে যা বলে বলুক তাতে আমার কোন কষ্ট হবে না। অহনা তার সিদ্ধান্তের কথা বাবা মাকে জানিয়ে দেয়।তার বাবা মা মেয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।
কিছু দিন পড় অহনার এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান পৃথিবীতে আসে। শুরু হয়ে গেলো অহনার লড়াই। অহনা পাহাড়ী মেয়ে অনেক সাহসী লড়াকু তাই তার লড়তে কোন ভয় নেই। ভালোবাসায় জন্ম নেওয়া এই সন্তানের স্বীকৃতি মাসুদ বা এই সমাজ যদি না দেয় তবুও হে তাল সন্তানকে লালন পালন করে বড় করে তুলবে তার পরিচয়ে। বিশ্বের সকল কুমারী মাতাদের সমাজ যে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে তা অহনা জানে এবং তাকেও যে নিশ্চয়ই সে দৃষ্টিতে দেখবে তা মেনে নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নেন এবং তার সন্তানকে নিয়ে তার লড়াই শুরু হয়। এবং নিজেকে কুমারী মা হিসেবে পরিচয় দেন।
আমার ছোট গল্পের মধ্যেই বলতে চাই এখনো এমন অনেক পাহাড়ী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটেছে এবং অহনার মত হাজারো কুমারী মা তাদের জীবন দিয়ে তাদের সন্তানদের মানুষ করছে। এ সমস্ত কুমারী মাদের জানাই স্যালুট।