বিভাগ-গল্প
নাড়ু, ( অন্য রহস্য)
রত্না চক্রবর্তী
৬.১২.২১.
আজকে আবার এসেছি অন্যরহস্যের একটা ঘটনা নিয়ে। এটা আর পুরোনো গল্প নয়। সম্প্রতি ঘটা একটি ঘটনা। এঁরা আমার খুব চেনাজানা এক পরিবার। প্রায় নিজের পরিবারের লোক বললেই হয়। এ ঘটনাটা ঘটেছে এই বছর পুজোয়। একদম সাধারন ঘটনা কাকতালীয় বলা যায় তবে বড় মন কেমন করা এটা বলতে পারি।
এখনতো লকডাউন এর সবাইকারই অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। দিনদিন অবনতি ছাড়া উন্নতি তো হচ্ছে না। তা আমারই পাড়ায় এদের লোহার আলমারি জিনিসপত্র সারানোর, রঙ করার কারখানা। কারখানা বলতে ছোটখাটো, নিজেরা জনা চারেক কর্মী নিয়ে কাজ করে। তাই এই ব্যবসাও লকডাউনে প্রচন্ড মার খেয়েছে।প্রথমদিকে তো কোনো কাজই ছিল না এখন সামান্য অল্প অল্প কাজ আছে। তিনটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে খুবই টানাটানি যাচ্ছে। তার সব ঘরেই তো একই অবস্থা, যারা আমাদের মত টিউশনি করে চলত তাদের অবস্থাও খারাপ। প্রতিটি মানুষেরই অবস্থা খারাপ যাচ্ছে সারা পৃথিবী যখন এরকম একটা ভয়ানক সমস্যার সম্মুখীন তখন তো এমন হতে বাধ্য। মেয়েটি আমায় মাসিমা বলে আর ঘরের সব সুখ দুঃখের গল্প করে। পূজোর মুখোমুখি বাচ্চাদের অল্পস্বল্প জামাকাপড়ও কিনে দিতে হয়েছে। এবার ছোটছেলেটা মায়ের কাছে বায়না করছে,” মা তুমি কত সুন্দর নাড়ু কর, কতদিন করনি, নাড়ু করে দাও না মা। খুব খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি কিন্তু অনেকগুলো নাড়ু খাব। ”
মার মন ব্যথায় টনটন করে ওঠে। এই ছেলেটা তার কখনও কোন বায়না করে না। সেই ছেলে মুখফুটে চাইল কিন্তু তার হাতে টাকা নেই। পূজোয় সবাইকে একটু একটু হলেও দেওয়া আছে, চাঁদা আছে। এমনকি কারখানায় যে কজন লোক কাজ করে তাদের তো কিছু দিতে হবে। সংসার চালানোই দায় হয়ে উঠেছে। এক একটা নারকল বাজারে পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা চাইছে। তারপর গুড় বা চিনি লাগবে। মনে মনে ভাবে এখন আর করা যাবে না।
মুখে বলে,” দেখ বিজয়ায় আরো অনেকেই তো নাড়ু দেবে তখন খাস। ” ছেলে বলে,”কিন্তু তোমার হাতে নাড়ু বেশি ভালো খেতে মা। ”
ম্লান মুখে বলে,” আচ্ছা আচ্ছা সে হবেখন।”
এখানে বলে রাখি আমরা যে পাড়ায় বাস করি সেটা খুব জনবহুল অঞ্চল। আশপাশে মিনিবাসস্ট্যান্ড, অটোস্ট্যান্ড, রিক্সাস্ট্যান্ড আমাদের গলিতে অনেক লোকের বাস, এছাড়া বড় কোচিং আছে একটা। ছাত্র ছাত্রী গার্জেন যাতায়াত করে প্রচুর। আমাদের গলির শেষের দিকে একটা নিচু জমি আছে তার চারপাশে বেশ কিছু গাছ আছে কিন্তু জায়গাটা নোংরা থাকে, অনেক দিন আগে সবাই নোংরা ফেলত। এখন আর কেউ ফেলে না কিন্তু সেখানে বড় একটা কেউ যায়না। বর্ষায় ডোবা হয়ে যায়। এই জমিটার নিয়ে গণ্ডগোল আছে। এখানে কোন জমি খালি পড়ে নেই। বহু বছর এটার কি সব মামলাটামলা বোধহয় চলছিল। একবার ফ্ল্যাট হবে শুনেছিলাম কিন্তু হয় নি।
ধারে ধারে কচুগাছের ঝোপ, নারকেল গাছ, খেঁজুর গাছ আছে। যাই হোক একদিন সকালবেলা ওই বাচ্চা ছেলেটির বাবা পায়চারি করছে গলির এ মোড় থেকে ও মোড়, প্রায় রোজ সকালেই করে। তা সে ওই ডোবার কাছে গিয়ে অবাক হয়ে গেল। তিনটে নারকেল একদম ডোবার ধারে পরিষ্কার জায়গায় পড়ে আছে । গাছ থেকে আপনি পড়েছে! তখন ভোর নয়, বেশ সকাল। ওই পথেই খবরের কাগজ দিয়ে গেছে কাগজওয়ালা বাড়ি বাড়ি, যারা মর্নিংওয়াকে যায়, তারা গেছে, দুজন ফিরেওছে কিন্তু কেউ নেয় নি! সে ইতস্তত করে নারকোলগুলো তুলে নিলো। এই জমিটি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে জানা নেই, কাজেই নিলে কারো বলার কিছু নেই। এতক্ষণ সেগুলো কেউ নেয় নি সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। সে তুলে ঘরে নিয়ে এল আর একটু নিচু হয়ে দেখল আরো দুটো নারকেল পড়ে আছে ডোবার একদম কিনারে। সেগুলো জলে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে।
সত্যি বলতে কি আমাদের এখানে পাঁচিলের ধারে একটা ফুলগাছ থাকলেও সেখানে ফুল রাখা যায় না। যারা সকালে হাঁটতে আসেন, তারা তুলে নিয়ে যান, ছোট পেয়ারা গাছ থাকলেও বাইরের দিকে ফল পড়লে, কি হাতের কাছে থাকলে ছিঁড়ে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু এইখানে এগুলো কেউ তুলে নিয়ে যায় নি তার ভারী অদ্ভুত লেগেছিল। বাড়ি এসে ভেঙে দেখা গেল তার মধ্যে তিনটি নারকেলই খুব ভালো আছে আর দুটো থেকে কল বেরিয়ে গেছে সেগুলো জলে ডুবে ছিল। বাচ্চাটির মা তো ভারি অবাক এবং খুশী। একটা কিছু পড়তে না পড়তেই যেখানে হাওয়া হয়ে যায় সেখানে এরকম ভাবে নারকেল যেন কেউ সাজিয়ে রেখে গেছে এটা কি করে সম্ভব! চিনি দিয়ে তার মা নাড়ু করে দিল।
বিজয়ায় যখন আমার বাড়ি প্রণাম করতে এসেছিল তখন নাড়ু দেখে আমি বলেছিলাম, ” আবার মিছিমিছি এতো খরচা করে করতে গেলি কেন মা? ”
তখন মেয়েটি আমাকে গল্পটি বলে,” ও মাসিমা আমি কিছুই করিনি গো, আমার ছেলে খেতে চেয়েছে বলে ভগবানই পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
তা কথাটা সত্যি, আমি বিশ্বাস করি মনে মনে শিশুর খেতে ইচ্ছে ছিল বলে ভগবান পাঠিয়ে দিয়েছেন। শিশুর মনের আকাঙ্খা মিটিয়েছেন।