রেজাউল করিম খান
দৃষ্টিপাত
মরণোত্তর দেহদানে আতঙ্কের কিছু নেই
মরণোত্তর দেহ ও চক্ষুদানের কথা শুনলে এখনো অনেকে আঁতকে ওঠেন। না জানি এই ব্যাপারটি কত ভয়ংকর! আসলে কি তাই? প্রায় পাঁচ বছর আগে একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে পড়েছি, এক ভদ্রলোক তার মৃত্যুর পর দেহটি দান করার জন্য গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে। ওই বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরীকে তার বাসনার কথা জানালেন। মরণোত্তর দেহদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তিনি মধ্যবয়সি লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে কীভাবে এফিডেভিট করে দেহদান করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন। প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে লোকটি বলেছিলেন, মরণোত্তর দেহদান করলে তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে অনেক মানুষ বেঁচে থাকবে। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নের সুযোগ পাবে।
চিকিৎসায় শিক্ষা ও গবেষণার জন্য মানুষের লাশ খুবই প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে সহজে তা পাওয়া যায় না। এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে গবেষণার বহু সুযোগ আছে। যেমন ব্রেনের মধ্যে অনেক জিনিস আছে, ফাংশনালি অনেক রহস্য আছে। যেগুলো এখনো মানুষ উদঘাটন করতে পারেনি। দেহদান করা হলে গবেষণার মাধ্যমে অনেক রহস্যের উদঘাটন করা সম্ভব।
দেহদান করতে হয় স্বেচ্ছায়। তাকে একটি ডিক্লারেশন দিয়ে মেডিকেল ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় স্বজনরা এটি মেনে নেন না। যে কেউ চাইলেই দেহ দিতে পারেন। কিন্তু দেহদানের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মৃত্যুর পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাশ মেডিকেলে পৌঁছানো গেলে কিডনি প্রতিস্থাপন হতে পারে। নেওয়া যেতে পারে চোখের কর্নিয়া। কিন্তু অনেক সময় দেহ পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বাংলাদেশে মরণোত্তর দেহদানের প্রতিশ্রুতি যত পাওয়া যায় দেহ তত মেলে না। এক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য বেওয়ারিশ লাশের ওপর নির্ভর করতে হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগ জানায়, গত ২০ বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট ৬৫ জন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন। গত ১৯ বছরে পাওয়া গেছে মাত্র ১২টি দেহ। এরমধ্যে তিনটি মিলেছে দান থেকে আর তিনটি বেওয়ারিশ লাশ থেকে সংগ্রহ করা। বাকি ছয়টি আগে প্রতিশ্রুতি না দিলেও হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর দেহদান করে দিয়ে যান তাদের স্বজনরা। এরমধ্যে সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী এবং ত্রিমতি চট্টোপাধ্যায় নামে আরেকজনের লাশ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কঙ্কাল বানিয়ে রাখা হয়েছে। মোট কঙ্কাল আছে পাঁচটি।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন এবং নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের লাশও আছে এই হাসপাতালে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে অথবা ময়নাতদন্ত করার পর অনেক সময় সেসব লাশ নেওয়া হয় না। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের লাশ বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তার পরিবারের অনুরোধে।
মরণোত্তর দেহদান করতে হলে প্রথমে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অথবা হাসপাতালে পরিচালক বরাবর নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। এরপর ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে আদালতের মাধ্যমে দানপত্র বা অঙ্গীকারনামার হলফনামা তৈরি করতে হয়। তাতে দাতা, গ্রহীতা এবং সাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা থাকে। আবেদনপত্রের সঙ্গে দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও ফোন নম্বরসহ পরিবারের আরো কিছু তথ্য দিতে হয়। পরিবারে সদস্যদের সম্মতিপত্র থাকতে হয়। আর মৃত্যুর পর খবর দিয়ে লাশ পরিবারের সদস্যদেরই পৌঁছে দিতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে ডেথ সার্টিফিকেট। পুলিশ কেস এবং ময়নাতদন্ত করা লাশ নেওয়া হয় না। অঙ্গীকারের পরও যদি তার সন্তান বা স্ত্রী না চান তাহলে লাশ নেওয়ার কোনো বিধান নেই।
মৃত্যুর পর আপনার শরীর মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেয়ে একাধিক মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে কিংবা যুগ যুগ চিকিৎসা অধ্যয়নে কাজে লাগছে, এর চেয়ে মহৎ আর কী হতে পারে। যা নিয়ে গর্ববোধ করতে পারেন পরিবারের সদস্যরাও।
পৃথিবীর আলো, রং, রূপ আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ধরা দেওয়ার জন্য যে অঙ্গটি সবচেয়ে জরুরি সেটা হলো চোখ। দৃষ্টিহীন মানুষের মতো অভাজন আর হয় না। দৃষ্টিহীন সেই অন্ধকারের কথা হয়তো দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের অনুভবের বাইরে। আগের দিনে দৃষ্টিহীনরা অন্ধত্বকে ঈশ্বরের অভিশাপ বা ভাগ্যের লিখন বলেই মেনে নিত। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে; আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক ধরনের অন্ধত্ব রোধ করা যায়। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা বা রোধের অযোগ্য অন্ধত্বের জন্য অন্যের চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মানুষ মরে গেলে তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কিছুদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। তাই মরেও নিজের চোখ অন্যকে দানের মাধ্যমে চাইলেই বেঁচে থাকা যায় পৃথিবীর আলো-রঙের মাঝে। মৃত্যুর পর অন্যকে কর্নিয়া দানের রীতিকেই মূলত বলে মরণোত্তর চক্ষুদান। সন্ধানী ন্যাশনাল আই ডোনেশান সোসাইটির তথ্য মতে বাংলাদেশে ১৪ লাখ লোক দৃষ্টিহীন। যাদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী অনেক দিন থেকেই মরণোত্তর চক্ষুদান বিষয়ে কাজ করছে। তাদের উদ্যোগেই প্রতি বছর ২ নভেম্বর আমাদের দেশে মরণোত্তর চক্ষুদান দিবসও পালন করা হয়। সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে ডোনারের মুখের সৌন্দর্যহানি না ঘটিয়ে সম্পূর্ণ চোখ তোলার পরিবর্তে শুধু কর্নিয়া সংগ্রহ করে থাকে। কেউ চক্ষুদান বিষয়ে আগ্রহী হলে প্রথমে তাকে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির দেওয়া অঙ্গীকারপত্র সংগ্রহ করতে হয়। তারপর তা যথাযথভাবে পূরণ করে সন্ধানী চক্ষু ব্যাংকের ঠিকানায় পাঠাতে হবে। এরপর ডোনারকে চক্ষু ব্যাংক থেকে একটি ডোনার কার্ড সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলার প্রয়োজন যে, সংশ্লিষ্ট ডোনারকে মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ সন্ধানী ইউনিট অথবা সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতিতে খবর পাঠাতে হবে। দেশে অন্ধত্ব মোচনের প্রত্যয় নিয়ে ১৯৮৪ সালে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্ধত্ব মোচন (চক্ষুদান) আইন, ১৯৭৫ অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। সমিতি সূত্র জানায়, গত ৩৫ বছরে তারা ৪ হাজার ২৮টি কর্নিয়া পেয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৭টি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত সমিতিতে মরণোত্তর চক্ষুদানের ৩৮ হাজারের বেশি অঙ্গীকার জমা পড়েছে।
আমাদের দেশে এখনো অনেকে চক্ষুদান বিষয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন। এর মূল কারণ হিসেবে মনোবিদরা চিহ্নিত করেছেন সচেতনতার অভাব, ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা ও আইনি জটিলতাকে। এ ছাড়া অনেকে কেবলমাত্র লাশের অঙ্গহানির ভয়েই চক্ষুদান থেকে বিরত থাকেন। তাই বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় কর্নিয়া প্রাপ্তির সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। আমাদের দেশে অনেকেই কেবলমাত্র ধর্মীয় বিধিনিষেধের ভয়ে ইচ্ছা সত্ত্বেও চক্ষুদানে আগ্রহী হন না। অথচ বৌদ্ধ, হিন্দু ও স্রস্টিান ধর্মগ্রন্থগুলোতে চক্ষুদানের ব্যাপারে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আছে বলে প্রমাণ মেলে না। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদেরও চক্ষুদানে কোনো বাধা নেই।
মরণোত্তর চক্ষুদান একটি মহৎ সেবা। এই সেবাকে সবার মাঝে পৌঁছে দিতে যেমন প্রয়োজন সচেতনতা তেমন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সেইসঙ্গে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। তাহলেই অন্ধ মানুষ ফিরে পাবে তার দৃষ্টি।
ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের চোখ দিয়ে নতুন করে পৃথিবী দেখছেন কলেজ শিক্ষক ইকবাল কবীর ও স্বাস্থ্যকর্মী রেশমা নাসরীন। তাদের দুই চোখে ভাষা সৈনিকের দুই কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য দেহ ও সন্ধানীকে চক্ষুদানের সিদ্ধান্তের কথা জানান আবদুল মতিন। মারা যাওয়ার পর তার চোখ সংগ্রহ করে সন্ধানী। রাজধানীর সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে তার দুই কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয় ইকবাল ও রেশমার চোখে। রেশমা নাসরীন (২৭) ঢাকার ধামরাই উপজেলার শিয়ালপুর গ্রামের বাসিন্দা। এখন তিনি দেখতে পাচ্ছেন। ইকবাল কবীর (৪০) ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার বাংলাবাজার চাঁদগাজী স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। গ্লুকোমায় আক্রান্ত হয়ে দুই বছর আগে তিনি বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন।
এরও আগে ২০১২ সালে সাংবাদিক ও কবি ফয়েজ আহমদের দান করা দুই চোখের দুই কর্নিয়ায় দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন ২৯ বছর বয়সি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তাজহারুল ইসলাম ও ২৫ বছর বয়সি ডাক্তার মো. সাইফুল ইসলাম। ২০০২ সালে মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছিলেন ফয়েজ আহমদ। নিজের শরীরটাও দান করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে হাসপাতালকে।
বাংলাদেশে কর্নিয়াজনিত অন্ধের সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। অপর দিকে সরকারের হিসাব মতে দেশে প্রতি বছর ১১ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতি বছর মারা যাওয়া এসব মানুষের মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশের কর্নিয়া পেলেও দেশ থেকে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করা সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rezaul.natore@yahoo.com