অরুন্ধতী রায়
রেজাউল করিম খান
নানা কারণেই কোনও কোনও দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। এর পেছনে শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন প্রভৃতি ইতিহাস থাকে। জনগণের একটি অংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
সরকার একে বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী, জঙ্গি প্রভৃতি নামে অভিহিত করে এবং নিষ্ঠুর হাতে তা দমনের চেষ্টা করে। তেমনই এক আন্দোলন ষাট দশকের শেষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ছিল নকশাল আন্দোলন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ একদল মানুষ চারু মজুমদারের নেতৃত্বে শ্রেণি শত্রু খতমের নামে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। বেশ দ্রুতই সেই অন্দোলন গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক তরুণ এতে যোগ দেন। এই আন্দোলন দমনের জন্য সরকার চরম পন্থা গ্রহণ করে। সরকারি বাহিনী হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে ১৯৭২ সালে নকশাল আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এর রেশ রয়ে যায়।
কিছুকাল পরই নকশাল অর্থাৎ মাওবাদীরা আবার তৎপরতা শুরু করে। ভারতের ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। তারা চায় ভারত সরকারের পতন। এই লক্ষ্যে চলছে সশস্ত্র লড়াই।
বিগত কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদীদেরকে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ভারতের অখন্ডতা রক্ষায় ও মাওবাদী দমনে সেনা, পুলিশ, বিএসএফ, কোবরা, স্কোরপিয়নসহ সকল সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয় অপারেশন গ্রীণহাটের অধীনে। মাওবাদীদের অধিকাংশই পাহাড়ী, আদিবাসী। পাহাড়-জঙ্গলেই তাদের বসবাস। আপাতদৃষ্টিতে তারা নিরিহ, নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। কিন্তু কেন তারা ভারতের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার উচ্ছেদ চায়, কেন তারা বিদ্রোহ করলো, অস্ত্র হাতে তুলে নিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় গভীর জঙ্গলে গিয়ে মাওবাদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। ক্যাম্পে থেকেছেন। তাদের কথা শুনেছেন।
রাষ্ট্র কিভাবে উন্নয়নের নামে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে তাদের শোষণ করছে, গ্রামবাসীকে উচ্ছেদের জন্য গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। হত্যা, লুট ও নারী ধষণ করা হচ্ছে। ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা প্রভৃতি এলাকা খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। খনি কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পাগিুলোর কাছে এসব এলাকা স্বপ্নপুরী। কিন্তু ৬০ প্রায় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ভারত সরকারের কর্তৃত্ব খুবই কম। কোম্পানিগুলোর সহায়তায় সরকার এইসব এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। অরুন্ধতী রায় এসবই খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর লেখার বাংলা অনুবাদ করেছেন মেহেদী হাসান। সেখান থেকে কিছু অংশ এখানে প্রকাশ করা হলো।
অরুন্ধতী রায় মাওবাদীদের সাক্ষাৎ পাবার বাসনা জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। একদিন সকালে দরজার নিচ দিয়ে প্রবেশ করানো একটি খাম পাওয়া গেল। খামের ভেতর সাদা কাগজে টাইপ করা একটি চিরকুট। তাকে ছত্তিশগড়ের দান্তেবড়ায় মা দান্তেশ্বরী মন্দিরে যেতে বলা হয়েছে। যাবার জন্য দুই দিনে চারটি সময় নিধারণ করা ছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, গাড়ির চাকা বারবার পাংচার হওয়া, অবরোধ, পরিবহন ধর্মঘট এসব মাথায় নিয়ে সেখানে যেতে হয়েছিল। চিরকুটে লেখা ছিল, সাথে ক্যামেরা, কপালে পরার জন্য লাল টিকা রাখতে। সাথে নারকেল থাকলে ভাল হয়।
অভ্যর্থনাকারীর মাথায় টুপি, হাতে হিন্দি ‘আউটলুক’ ম্যাগাজিন থাকবে। সংকেত ‘নমস্কার গুরুজি’। দান্তেবড়া একটি আজব শহর। সেখানে পুলিশ থাকে সাদা পোশাকে আর বিদ্রোহীরা ইউনিফর্ম পরা। জেল সুপার থাকে জেলে আর বন্দিরা থাকে বাইরে।
ধর্ষিতা নারীরা থাকে পুলিশ হেফাজতে আর ধর্ষকরা বাজারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। ইন্দ্রাবতীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যেসব অঞ্চলে মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাকে পুলিশ ‘পাকিস্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। সেখানে গ্রামগুলো মানুষশূন্য আর জঙ্গল মানুষ ভর্তি। যে শিশুদের স্কুলে যাবার কথা, তারা জঙ্গলে দৌড়ায়।