পাকিস্তানের অপরাধ লঘু করার জন্য সচেতনভাবেই ভারতবিদ্বেষ ছড়ানো – স্বকৃত নোমান
এবং যারা পাকিস্তনবিদ্বেষের সঙ্গে ভারতবিদ্বেষকেও যুক্ত করে দেন, তারা প্রকারান্তরে পাকিস্তানের অপরাধকে লঘু করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালান। যেমন একজন বললেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের একটা অংশ পাকিস্তানপ্রেমী, আরেক অংশ ভারতপ্রেমী।’ প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেকে ভালোবাসে পড়শিকে ভালোবাসলে দোষ কোথায়? ভারত তো আমার পড়শি। এই পড়শি তো আমাকে কখনো শত্রু জ্ঞান করেনি, আমাদের ওপর কখনো বর্বরতম গণহত্যা চালায়নি; বরং দুষ্কালে আশ্রয় দিয়েছে, সহায়তা করেছে।
আর ভারত তো আমারও। আমি তো ভারতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির একটা বৃহৎ অংশের উত্তরাধিকারী। একদা আমিই তো এই ভারতভূমিতে অনার্য হয়ে বসত করেছি, দুর্গা নাম নিয়ে শত্রুবধ করেছি, কৃষ্ণ নাম নিয়ে মুরলি বাজিয়েছি, অর্জুন নাম নিয়ে ন্যায়যুদ্ধ করেছি, যুদ্ধিষ্ঠির নাম নিয়ে সত্য প্রতিষ্টা করেছি, গুরুনানক, শ্রীচৈতন্য, খাজা মঈনুদ্দীন হয়ে মানবতার গান গেয়েছি।
আমিই তো পুরু হয়ে প্রতিরোধ করেছি সা¤্রাজ্যবাদী আলেকজান্ডারের আগ্রাসন। আমিই কোটিল্য, ঘোষণা করেছি জ্ঞানের মহাত্ম্য। আমিই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুসার, অশোক। আমি বাবর, হুমায়ূন, আকবর, শাহজাহান। আমি মুর্শিদকুলি, আলীবর্দী, সিরাজ-উদ-দ্দৌলা। ফতেহপুর সিক্রি আমার, তাজমহল আমার, কুতুব মিনার আমার, মুর্শিদাবাদের প্রাসাদ আমার, কলকাতা আমার, ত্রিপুরার রাজমহলও আমার। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত আমার। চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য আমার। আমি ভারতজাত বাঙাল গোত্রের সন্তান। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি একই উৎসমূল থেকে উৎসারিত। আমার অখ- সত্তাকে বৃটিশ বেনিয়ারা কেটে দুই ভাগ করেছে। তবু আমি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নই। সময়ের প্রয়োজনে বসত করার জন্য আলাদা ভূখ- বেছে নিয়েছি মাত্র, একই উৎস থেকে উৎসারিত জলপ্রবাহ যেমন আলাদা নাম নিয়ে নদী হয়ে প্রবাহিত হয়।
দাঁড়ান। আমাকে প্রতিহত করার জন্য আপনার হাতে কয়েকটি ট্রাম্পকার্ড আছে। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, পাকিস্তানও তো একদা ভারতের অংশ ছিল। সুতরাং পাকিস্তানপ্রীতিতে দোষ কোথায়? নাহ্, কোনো দোষ নেই। পাকিস্তানও আমার পড়শি। কিন্তু এই পড়শি আমার সঙ্গে অন্যায় করেছে, ঘোরতর অপরাধ করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তান বর্বরতম গণ্যহত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ না করবে, ক্ষমা না চাইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত একজন বাঙালি হিসেবে, একজন বাংলাদেশি হিসেবে পাকিস্তানকে আমি শত্রুরাষ্ট্র জ্ঞান করব।
আপনি আরো প্রশ্ন করতে পারেন, এতক্ষণ যে আমি ভারতবন্দনা করলাম, ভারত যে সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করে, সে ব্যাপারে আপনার কী মত? ভারত যে আমাদেরকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিচ্ছে না, সে ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? সবিনয় উত্তর, সীমান্তহত্যা অবশ্যই নিন্দনীয়। কোনোভাবে এই হত্যাকা- সমর্থনযোগ্য নয়। পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়াও প্রকৃতিবিরুদ্ধ নিন্দনীয় অপরাধ। এই অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম, আছি এবং থাকব। একই সঙ্গে এই কথাও বলব, বিচ্ছিন্ন ও অনাকাক্সিক্ষত সীমান্তহত্যা, পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়া কোনোভাবেই পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যার সঙ্গে তুলনীয় নয়, হতে পারে না।
এবং একই সঙ্গে আপনার প্রতিও আমার প্রশ্ন, আপনি সীমান্তহত্যা নিয়ে সোচ্চার, পানির হিস্যা নিয়ে সোচ্চার, কিন্তু মিয়ানমার যে এই দেশে সতের লাখ রোহিঙ্গা ঠেলে দিল, কোটি কোটি ইয়াবা ঢুকিয়ে দিচ্ছে, মাঝেমধ্যেই যে এই দেশের জেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে―এসব ব্যাপারে তো আপনার কোনো বক্তব্য নেই। কেন নেই? ভারতকে আপনি শত্রুরাষ্ট্র জ্ঞান করেন, অথচ মিয়ানমারকে করেন না। কেন করেন না? কেন আপনার মধ্যে এই দ্বিচারিতা? সুতরাং এই কথা পরিষ্কার যে, আপনি আসলে পাকিস্তানের অপরাধ লঘু করার জন্য সচেতনভাবেই ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে থাকেন। মৌলিকভাবে আপনি সন্দেহজনক চরিত্র।
মহাকালে রেখাপাত
২৩.১১.২০২১