ছোটগল্প
সুদীপ রায়
সাতবুড়োর একবুড়ো
রিটায়ার করে পঙ্কজের আজকাল নিজের চেহারার দিকে … মানে যাকে পারসোনাল গ্রুমিং বলে তার দিকে একেবারে নজর নেই। যতদিন চাকরী ছিল, ততদিন কী ঘরে, কী বাইরে, সবসময়ে একেবারে ফিটফাট থাকত। আর আজকাল ঠিক তার উলটো। চুল যেটুকু আছে তা আজকাল অবিন্যস্ত থাকে, চিরুনির বালাই নেই । তিনদিন অন্তর দাড়ি কামাচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ সময়েই সারা গালে কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বাড়িতে থাকলে পাজামা, ফতুয়া, বাইরে বেরুলে ট্রাউজার, বুশশারট। মঞ্জুশ্রী পঙ্কজের এই চেহারা দেখে রাগ করে বলে ‘সাতবুড়োর একবুড়ো’। পঙ্কজের কিন্তু তাতে হেলদোল নেই। তার যুক্তি অবসর জীবনে দেখতে কেমন লাগল তা নিয়ে অত ভাবনা চিন্তা থাকবেই বা কেন ? অফিস বলে জিনিসটাই একদিনের নোটিশে শেষ হয়ে গেল। এখন আর সাড়ে নটা বাজলেই না আছে ধড়াচুড়ো পরে অফিস যাওয়ার তাড়া, না আছে ডাক পড়লেই এম.ডি’র চেম্বারে স্যুটেড বুটেড হয়ে হাজিরা দেওয়া। ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং এর ব্যাপারও নেই। ঘরে আর হুট-হাট করে অফিসের লোক আসে না। সুতরাং সাজগোজ কিসের জন্য ? অতএব পঙ্কজের আজকাল সবসময়েই সবকাজেই বেশ যাকে বলে ওই গয়ং গচ্ছ ভাব। মঞ্জুশ্রীর অবশ্য পঙ্কজের এমন ছেড়ে দেওয়া ভাবটা ভালো লাগছে না মোটেই। নাই বা থাকল চাকরী। তা বলে এমন দায়সারা গোছের চেহারা নিয়ে মানুষটা কেন ঘুরে বেড়াবে ? কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে লোকটা এত বছর চাকরী করে এল তাকে এখন দেখলে মনে হয় যেন ভ্যাগাবন্ড। পঙ্কজের বড় শালা দুবাইতে থাকে। শালার ছেলের বিয়ে কোলকাতায়। আজ রাতে বিয়ে গ্র্যান্ড হোটেলে। শালা কোলকাতা এসে সপরিবারে গ্র্যান্ড হোটেলেই উঠেছে। এ কদিন মঞ্জুশ্রী পই পই করে পঙ্কজকে বলে চলেছেন হাবিবে গিয়ে চুলটা একটু ভদ্রস্থ ভাবে কেটে আসার জন্য। সকাল বেলায় ঠাকুর ঘরে ঢোকার আগে মঞ্জুশ্রী আল্টিমেটাম দিলেন। পঙ্কজ তার উস্কোখুস্কো চুলের একটা কিছু ব্যবস্থা আজ না করলে মঞ্জুশ্রী বিয়েতে যাবেন না। এমন ছাড়া-গরুর মত চেহারার লোককে নিয়ে পাবলিক ইভেন্টে যেতে মঞ্জুশ্রী রাজি নন। অনেক আত্মীয়স্বজন আসবেন। তারা এতদিন পঙ্কজকে যে সাহেবী চেহারায় দেখে অভ্যস্ত, তাতে পঙ্কজের এরকম কেয়ারফ্রী আনকেম্পট লুকে, এরকম অধঃপতন দেখে জোর ধাক্কা খাবে। সে মঞ্জুশ্রী কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবেন না। পাক্কা দুঘন্টা পরে ঠাকুর ঘর থেকে পূজো সেরে বাইরে বেরুতেই ডোরবেল। পঙ্কজকে দরজা খোলার জন্য আওয়াজ দিয়েও সাড়া পেলেন না মঞ্জুশ্রী। হয়তো ছাদে বাগানের পরিচর্যা করছেন। অগত্যা নিজেকে গিয়েই দরজা খুলতে হল। বাইরে মাথায় পানামা হ্যাট পরা, রে ব্যান সানগ্লাস চোখে, হাতে ফ্যাশনেবল ওয়াকিং স্টিক, স্যুট পরা ফ্রেঞ্ছকাট দাড়ির এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক। দেখলেই সমীহ হয়। দরজা খুলতেই উনি জলদ্গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ‘ইজ মিঃ পঙ্কজ দত্তা হোম ?’ এ আবার কে এলরে বাবা ? গলার আওয়াজটা কেমন যেন আধাচেনা ঠেকল। মঞ্জুশ্রী কোনোমতে ঢোক গিলে বলল ‘ইয়েস … নো … আই ডোন্ট নো।‘ ভদ্রলোক খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘এক্সকিউজ মী। আই এম পানু, কান্ট ইউ রেকগনাইজ মী ?’ ও হরি … এ যে পঙ্কজ, কিন্তু এ কী গেট আপ ? ‘তুমি, এ বেশে কোথা থেকে ? বাড়ির বাইরে কখন বেরুলে ? এসব কী ব্যাপার ?’ এক নিঃশ্বাসে এতগুলো প্রশ্ন করে থামল মঞ্জুশ্রী। ‘হাবিবে গিয়েছিলাম তুমি ঠাকুরঘরে ঢুকতেই। ওদের বললাম একটা স্পেশ্যাল গেট আপ করে দিতে গ্র্যান্ডে বিয়ে এটেন্ড করার জন্য। ওরাই ফোন করে ওদের পার্ক স্ট্রীট স্যালোঁ থেকে স্পেশালিস্ট মেক আপ আর্টিস্ট আনিয়ে আমাকে পারসোনাল গ্রুমিং করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিল। জামাকাপড়, একসেসরি সবই ওদের। ভাড়ায় নিয়েছি। আজ স্নান করতে বারণ করে দিয়েছে। এখন বল কেমন লাগছে। মঞ্জুশ্রী হেসে বলল ’আমি তো ঘাবড়েই গেছলাম। ভাবলাম এই সাহেব আবার কোথা থেকে এসে হাজির হল।‘ ‘সে তো তোমার তুতলিয়ে ‘ইয়েস’, ‘নো’ শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম। আজ রাতে রিসেপশনে এই গেট আপ চলবে তো ?’ পঙ্কজ বলল। ‘হ্যাট আর লাঠি চলবে না। তুমি অত বুড়ো হও নি। বাকিটুকু পারফেক্ট ‘ ‘তাহলে কতখানি বুড়ো হয়েছি আমি, সাতবুড়োর একবুড়োর মত কি ?’ বলে পঙ্কজ মঞ্জুশ্রীকে বুকে টেনে নিল। মঞ্জুশ্রী পঙ্কজের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল ‘যাও … জানি না।‘