লেখক স্বকৃত নোমান এর ‘ গ্রাম্যতা ‘
গ্রাম্যতা
স্বকৃত নোমান
‘গ্রাম্যতা’ শব্দে অনেকের আপত্তি। আপত্তির কারণ, ‘গ্রাম্যতা’ শব্দ দ্বারা গ্রামের মানুষদের খাটো করা হয়, অপমান করা হয়। হ্যাঁ, করা হয় বটে। গ্রামের মানুষ খারাপ কেন হবে? গ্রামের মানুষ শহরের শিক্ষিতদের মতো দুর্নীতি করে না, ঘুষ খায় না। তারা শস্য উৎপাদন করে। সেই শস্য খেয়ে আমরা, এই শহুরেরা, বেঁচে থাকি। এটা গ্রামের মানুষদের সবচেয়ে বড় অবদান। এর তুলনা নেই। এজন্য তাদের ষষ্ঠাঙ্গ প্রণাম।
কিন্তু গ্রাম মানেই কি ভালো? খারাপ দিক কি নেই গ্রামে? গ্রামের সবকিছু ভালো, গ্রাম মানেই শান্তি আর সুখের আবাস—যাঁরা এ ধারণা পোষণ করেন, তাঁরা হয় কখনো বাংলার গ্রাম দেখেননি কিংবা দেখেও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে মিছে তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গ্রামগুলো কেমন জানি না। বাংলা-ভারতের গ্রামগুলো কেমন জানি। গ্রামের অধিকাংশ (খেয়াল রাখা দরকার, আমি সচেতনভাবে ‘অধিকাংশ’ শব্দটি ব্যবহার করেছি) মানুষের বৈশিষ্ট্য কী? একজনের পেছনে আরেকজন লেগে থাকা। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে, ‘একজনের পাছায় অন্যজন আঙুল দিয়ে বসে থাকা।’ একজনের ভালো আরেকজন সহ্য করতে না পারা। পরশ্রীকাতরতা চর্চার উর্বর ক্ষেত্র বাংলাদেশের গ্রামগুলো। ভিলেজ পলিটিক্স কাকে বলে, যারা গ্রামে থাকেননি, তারা এই পলিটিক্স বুঝতে পারবে না। এ বড় ভয়ংকর পলিটিক্স।
প্রাপ্তবয়ষ্ক দুজন নর-নারী ঢাকা শহরের কোনো পার্কে বসে প্রেম করতে পারবে, চুমুও খেতে পারবে, কেউ বাধা দেবে না। শহরে নারীরা বোরকা পরল, সেলোয়ার-কামিজ পরল, না জিন্স-টপস পরল, না গাড়ি ড্রাইভ করল—তাতে অন্যের কিছু যায়-আসে না। আপনি সাকুরা বা ডিপিএল বার-এ গিয়ে মদ খেতে পারবেন, কেউ বাধা দিতে আসবে না। আপনার বাসায় আপনি যেমন ইচ্ছা থাকতে পারবেন, পাশের বাসার কেউ আপনার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করবে না। আপনি ধর্মকর্ম করলেন কি করলেন না, তা নিয়ে আপনার প্রতিবেশি মাথা ঘামাবে না। আপনি আপনার মতো জীবন-যাপন করছেন, প্রতিবেশী প্রতিবেশীর মতো। অর্থাৎ ব্যক্তি হিসেবে আপনি স্বতন্ত্র। আপনি তথাকথিত সমাজের কাছে দায়বদ্ধ নন।
অপরপক্ষে গ্রাম? তুমি ঐ মেয়েটিকে নিয়ে পুকুরপাড়ে বসলে কেন? তুমি মদ খাও কেন? তুমি নামাজ পড়ো না কেন? শুক্রবারে মসজিদে যাও না কেন? পূজায় মন্দিরে যাও না কেন? তোমার বউ বোরকা পরে না কেন? তোমার মেয়ের বুকে ওড়না নেই কেন? তুমি কবিতা লেখ কেন? গান গাও কেন? লম্বা চুলের একতারা হাতে লোকটা বাউল? দাও তার চুল কেটে। শালা বেশরা ন্যাড়ার ফকির! তুমি সমাজের কথা মানো না কেন? মানবে না? ঠিক আছে, তোমাকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হলো, একঘরে করা হলো।
গ্রামে কি সহজ-সরল মানুষ নেই? আছে তো বটেই। অসংখ্য আছে। কিন্তু সে শান্তি পায় না গ্রামে। ভিলেজ পলিটিক্স তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। সে সেই অশান্তিকে নিয়তি বলে মেনে নেয়। মেনে নিয়ে বেঁচে থাকে। আপস করতে করতে বেঁচে থাকে।
গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করে ধর্ম ও রাজনীতি। আপনি শহরে রাজনীতি না করেও থাকতে পারবেন। কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। কিন্তু গ্রামে? বাংলাদেশের গ্রামের পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাজনীতিহীন থাকা মানে আপনি একজন অসহায়-বিপন্ন মানুষ। আপনার দাম নেই। কেউ আপনার কথা শুনবে না, আপনাকে শ্রদ্ধা করবে না। আর ধর্মহীন থাকবেন! প্রশ্নই আসে না। একথা শুনলেই গ্রামীণ সমাজ আপনার কল্লাটা নিয়ে নেবে। বাংলার গ্রামগুলোর এই পরিবর্তিত দশা দেখেই শাহ আবদুল করিমের আক্ষেপ : ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ সেই সুন্দরভাবে দিন কাটানোর গ্রাম এখন আর বাংলায় নেই। থাকলেও তার সংখ্যা কম।
ভোলার চর কুকরী মুকরী একটি চমৎকার গ্রাম। প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। আপনি ঢাকা থেকে সেখানে গিয়ে দুদিন খুব আরামে থাকতে পারবেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে কবিতাও লিখে ফেলতে পারবেন। কিন্তু স্থায়ীভাবে থাকতে যাবেন? এক মাসের বেশি টিকতে পারবেন না। কারণ আপনি টিভি দেখতে চাইবেন। বাড়িতে টিভি বসাবেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের লোকজন এসে আপনাকে ধরবে। তোমার বাড়িতে টিভি কেন? টিভি দেখা তো হারাম। তুমি হারাম কাজ করতে পারবে না। বাড়িতে টিভি রাখা যাবে না। বিশ্বাস হয় না? না হলে চর কুকরী মুকরী থেকে একবার ঘুরে আসতে পারেন। দেখে আসতে পারেন ধর্মনিয়ন্ত্রিত ওই চরের সমাজ ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাম চর কুকরী মুকরীর মতোই। বাড়িতে টিভি রাখতে বাধা না দিলেও আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো না কোনো কিছুতেই বাধা দেবেই। চর কুকরী মুকরীর মতো এ দেশের অধিকাংশ গ্রামে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলে কিছু নেই। ব্যক্তি তার নিজের ইচ্ছায় চলতে পারবে না। সমাজ তাকে হস্তক্ষেপ করবেই। এই হস্তক্ষেপই হচ্ছে অভদ্রতা, অশিষ্টতা, অসভ্যতা, অশ্লীলতা, বর্বরতা। এসব কারণেই ‘গ্রাম্যতা’ শব্দটির উদ্ভব।
সেই কারণে অর্থবিত্ত হলে এখন আর কেউ গ্রামে থাকতে চায় না, শহরে পাড়ি জমাতে চায়। শহর মানে ঢাকা, চট্টগ্রাম বা সিলেট শহর হতে হবে, তা নয়। যে কোনো জেলাশহরও হতে পারে, উপজেলা শহরও হতে পারে। শহরে সমাজের হস্তক্ষেপ তুলনামূলকভাবে কম। ‘একজনের পাঁছায় আরেকজনের আঙুল দেওয়া’ কম। শহরে ব্যক্তি স্বতন্ত্র্যভাবে বাঁচতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মানুষের বিকাশের জন্য জরুরি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চর্চার মধ্য দিয়েই মানুষ বিকশিত হয়। মানুষের বিকাশ মানে সভ্যতার বিকাশ। সুন্দর পৃথিবীর গঠন।
‘গ্রাম্যতা’ শব্দের উদ্ভব গ্রাম থেকে হলেও এখন এটি একটি টার্ম। একটি পরিভাষা। একটি মানসিক দশা। ‘গ্রাম্যতা’ কেবল যে গ্রামেই থাকে, তা নয়। শহরেও থাকতে পারে। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি বা রামপুরাতেও থাকতে পারে। আছেও বটে। সুতরাং ‘গ্রাম্যতা’ শব্দটি দোষণীয় কোনো শব্দ বলে মনে করি না। যতদিন গ্রামের অধিকাংশ মানুষের এই নেতিবাচক স্বভাব থাকবে, ততদিন শব্দটির প্রাসঙ্গিকতা থাকবে।
তবে আশার কথা, গ্রামের মানুষদের এই স্বভাব-চরিত্র বেশি দিন থাকবে না। গ্রাম বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে গ্রামের সংস্কৃতি। গ্রাম ক্রমে পরিণত হচ্ছে শহরে। গ্রামেও এখন ব্যক্তিসাতন্ত্র্য চর্চা ক্রমশ বাড়ছে। একদিন সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতি। তখন হয়ত ‘গ্রাম্যতা’ শব্দটিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এখন আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন, আমি গ্রামের যে খারাপ দিকগুলোর কথা বললাম, শহরের কি তেমন খারাপ দিক নেই? আছে তো বটেই। সেই খারাপ দিকগুলোর জন্য ‘গ্রাম্যতার’ বিপরীতে ‘শহুরতা’ শব্দের উদ্ভব ঘটতে পারে। ঘটলে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।