শ্রীকৃষ্ণ ও বন্ধু সুদামা – স্বকৃত নোমান
ভারতীয় দার্শনিক, সমরবিদ ও রাষ্ট্রবিদ শ্রীকৃষ্ণের এক ভক্ত ছিলেন। নাম সুদামা। সুদামা চরিত্রের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় ভারতীয় ভক্তিবাদের রূপ। সুদামা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় বন্ধু। বাল্যকালে গোকুলে তাঁরা একই সঙ্গে গুরুগৃহে শিক্ষা নিয়েছিলেন। খুবই গরিব ছিলেন সুদামা। যা পেতেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। ভিক্ষা করে খাবারের জোগাড় আর ভগবানের উপাসনাই ছিল তার প্রতিদিনের কাজ। তার স্ত্রী ছিল পতিব্রতা। স্বামীর দারিদ্র নিয়ে কখনোই মন খারাপ করতেন না। সবসময় সন্তুষ্ট থাকতেন।
একদিন দুঃখিনী স্ত্রী ক্ষুধার তাড়নায় কাঁপতে কাঁপতে স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন, হে স্বামী, সাক্ষাৎ লক্ষ্মীপতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আপনার বন্ধু। তিনি ব্রাহ্মণ ভক্ত এবং কেউ তার কাছে সাহায্য চাইলে ফেরান না। আপনি তার কাছে একবার যান। ভাতের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন জানলে আপনাকে তিনি অনেক ধন-সম্পদ দেবেন। তিনি এখন দ্বারকায় নিবাস করছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি না বললেও সেই দীননাথ আমাদের দারিদ্র দূর করে দেবেন।
স্ত্রীর তাগাদায় দ্বারকায় যেতে রাজি হলেন সুদামা। তবে অর্থের জন্য নয়। অর্থের জন্য যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি যাবেন শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে। কৃষ্ণের দর্শন মানে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। বন্ধুকে দেখতে যাবেন, সাথে তো কিছু উপহার নিতে হবে। স্ত্রীকে বললেন, কল্যানী, শ্রীকৃষ্ণকে উপহার দেওয়ার মতো ঘরে যদি কিছু থাকে তবে দাও। ঘরে তো কিছু নেই, কী দেবে ব্রাহ্মণী? আশপাশের ব্রাহ্মণবাড়ি থেকে চার মুঠো চিড়া চেয়ে এনে একটা কাপড়ের পুটলি করে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। পুটলিটা নিয়ে দ্বারকার পথে রওনা হলেন সুদামা। যেতে যেতে ভাবেন, শ্রীকৃষ্ণের সাথে কী করে তার দেখা হবে! কত বড় মানুষ কৃষ্ণ, কত বড় মহারাজা, আর সুদামা কত গরিব। দেখা কি তিনি আদৌ দেবেন?
দ্বারকায় পৌঁছে সুদামা অন্য ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞেস করে শ্রীকৃষ্ণের মহলের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। দ্বাররক্ষীরা তার দীনহীন দশা দেখে উপহাস করতে লাগল। দারোয়ানকে তিনি বললেন, ভাইরে, কৃষ্ণকে গিয়ে বলো তার সাথে দেখা করতে এসেছে তার বাল্যবন্ধু সুদামা। দ্বাররক্ষীরা প্রথমে আমলে না নিলেও পরে ভিতরে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বলল, প্রভু, দুয়ারে একজন অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ এসেছে। সারা গায়ে ধুলার আস্তর, পা দুটি ফেটে চৌচির। তার দারিদ্র দেখে দ্বারকার ধূলারাও আশ্চর্য হয়ে গেছে। সে বলছে তার নাম সুদামা, আর বলছে সে নাকি আপনার বন্ধু।
সুদামার নাম শোনা মাত্র সিংহাসন থেকে নেমে খালি পায়ে দুয়ারের দিকে ছুটলেন শ্রীকৃষ্ণ। দুয়ারে গিয়ে সুদামাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে বন্ধু, তুমি তো এসেছ, কিন্তু অনেক কষ্ট ভোগ করার পর এসেছ। দ্বারকায় তোমাকে স্বাগতম। বন্ধুকে তিনি নিজের শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। নিজহাতে পা দুখানা ধুইয়ে দিলেন। স্নান করিয়ে পরার জন্য দিলেন রেশমি কাপড়। নানা রকমের খাবার প্রস্তুত হলো। খেতে বসলেন দুই বন্ধু। পাখার বাতাস করতে লাগলেন খোদ রুক্মিনী । খেতে খেতে অনেকক্ষণ বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থন করলেন দুজন। খাওয়া শেষে কৃষ্ণ বললেন, বন্ধু, বৌদি আমার জন্য কী পাঠিয়েছে? সুদামা তো লজ্জায় লাল। সামান্য চিড়া বন্ধুকে তিনি কেমন করে উপহার দেন! কৃষ্ণ নিজেই পুটলি থেকে সেই চার মুঠো চিড়া বের করে খেলেন।
কিছুদিন দ্বারকায় থাকলেন সুদামা। নিজের অভাবের ব্যাপারে কৃষ্ণকে কিছুই বললেন না। না বললে কী হবে, শ্রীকৃষ্ণ তো সবই জানেন। তাঁর বিশাল গোয়েন্দা বাহিনী সব খবরই তাঁকে দেয়। সুদামার বাড়ির খবর পেয়ে তিনি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেন। একদিন দ্বারকা থেকে বাড়ি পৌঁছলেন সুদামা। বাড়িঘরের অবস্থা দেখে তো তিনি অবাক। এ কী কাণ্ড বাড়ির! সব বদলে গেছে। তার সব অভাব দূর হয়ে গেছে। কে বদলে দিয়েছে, বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। বুঝলেন, একেই বলে শ্রীকৃষ্ণের লীলা। এভাবেই তিনি ভক্তের পাশে থাকেন।