আজ ২৬শে অগস্ট রেডিওর জন্মদিন । চুরানব্বই বছর বয়স হল তার । শুভ জন্মদিন হে, কলকাতা রেডিও । আমাদের স্মৃতিচারণেই থাকো তুমি রেডিও ।
যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর’ (রবীন্দ্রনাথ) ।
আমাদের শৈশবের সাংস্কৃতিক জীবনের অনেক কিছুর মত, সেও হারিয়ে গেছে । তাকে আর আগলে বসে নেই শুধু স্মৃতিটুকু থেকে যায়, কিংবা আগলে রাখি – যতদিন রাখা যায় । বলছি রেডিওর কথা । ইতিহাস নয়, স্মৃতি – স্মৃতিচারণ । সেই স্মৃতিই হয়তো টেনে আনে ইতিহাসেরও তথ্য ।
আমাদের শৈশবে রেডিও ছিল পরম বিস্ময় । বিদ্যুৎ সংযোগ করলেই একটা চৌকো কাঠের বাক্সের ভেতর দিয়ে কথা, গান ভেসে আসতো । আর আমরা অবাক বিস্ময়ে সেই চৌকো বাক্সটার দিকে চেয়ে বসে থাকতাম, তা থেকে বেরিয়ে আসা কথা, গান শুনতাম অনেকটা সেই গ্রামফোন রেকর্ডে ছাপ মারা হিজ মাস্টার্স ভয়েসের সেই গ্রামফোনের চোঙার সামনে বসে থাকা কুকুরটার মত । বিস্ময় বৈকি ! আর কি মাধুর্যময় শব্দ । ভাবতাম এতো মাধুর্যময় শব্দোচ্চারণও হতে পারে ! শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত কেটেছে সেই বিস্ময়ের ঘোরে । তখন তো বিনোদনের এমন বন্দোবস্ত আর কিছু ছিল না । ছিল শুধু দম দেওয়া কলের গান, আর ছিল চলচ্চিত্র । সেও তো তখন অপরিণত, সবেমাত্র কথা বলতে শেখা, শৈশবের আমরা তার নাগাল পাবো কেন ? তাই আমার শৈশব-কৈশোরের প্রথম বিস্ময় রেডিও । আমাদের রেডিও কেনার সঙ্গতি ছিল না, জেঠিমার বাড়িতে আমার শৈশব-কৈশোরের রেডিও-স্মৃতি ।
রেডিওর প্রচলন বিনোদন ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেশ ও দুনিয়ার কথা জানার একটা সহজলভ্য ও অপরিহার্য বন্দোবস্ত ছিল ।
রেডিওকে ঘিরে আমাদের অনেক স্মৃতি যা ফুরোবার নয় । এখন রেডিওর যুগ প্রায় শেষ হয়েছে, রেডিও তার আভিজাত্য হারিয়েছে । কিন্তু একটা সময় ছিল যেদিন মধ্যবিত্ত মানুষের বিনোদনের যাবতীয় সম্ভার রেডিও নামক এই শ্রাব্য মাধ্যমে পরিবেশিত হত । সঙ্গীত, দেশ-দুনিয়ার সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, মহিলাদের আসর, সঙ্গীত শিক্ষা, গল্প বলার আসর, শিশুমহল, পল্লীমঙ্গল, নাটক, অনুরোধের আসরে পছন্দের গান শোনা, খেলার সরাসরি সম্প্রচার, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা – সব কিছুর জন্য রেডিওর আর কোন বিকল্প ছিল না । তখন রেডিও ব্যবহারকারীদের লাইসেন্স ফী দিতে হত । মনে পড়ে সম্ভবত ১৯৭০-৭১ সনেও বার্ষিক ১৫টাকার লাইসেন্স ফী দিয়েছি । কবে থেকে লাইসেন্স ফী দেওয়া উঠে গেল আমার স্মরণে নেই ।
‘স্মৃতিপীড়া’ কথাটা নস্টালজিয়া শব্দটির সঠিক প্রতিশব্দ হবে কি না জানি না । কিন্তু একথায় বোধকরি কোন সংশয়ের অবকাশ নেই যে বেশি দিন নয় । সত্তর দশকেও যাদের শৈশব কেটেছে তেমন মানুষ আজও রেডিওর কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ।
১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে (ডালহৌসিতে টেলিফোন ভবনের উলটো দিকে) ছিল রেডিও স্টেশন ও স্টুডিও । ১৯২৭এর ২৬শে অগস্ট কলকাতায় বেসরকারী উদ্যোগে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়, করেছিল ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানী । কলকাতার একমাস আগে তারাই বম্বেতে দেশের প্রথম বেতার ব্যবস্থার সূচনা করে ১৯২৭এর ২৩শে জুলাই । ১৯৩০এর মার্চে বেসরকারী রেডিও কোম্পানিটি দেউলিয়া হয়ে যায় । ফলে ১লা এপ্রিল ১৯৩০ থেকে বেতার সম্প্রচার ব্যবস্থা সরকার নিজের হাতে নিয়ে নেয়, নাম হয় ‘স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ । ৮ই জুন ১৯৩৬ থেকে সেই নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ ।
স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের কে না শুনেছেন ‘দিস ইস অল ইন্ডিয়া রেডিও, দি নিউজ রেড বাই……’ আর সকাল ৫টায় রেডিওর সেই অনন্য সিগনেচার টিউন (তিমিরবরণ কৃত) ! পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা সেই সিগনেচার টিউন শুনে আর ঘড়ি দেখতে হত না । রেডিওর সেই সিগনেচার টিউন ছিল যেন মামুষের কর্মব্যস্ততার দিন শুরু হওয়ার ছাড়পত্র ।
কৈশোরের কথা আজও মনে আছে । তখন রেডিও স্টেশনে তরুণদের গারস্টিন প্লেসের সেই বিস্ময় কেন্দ্র ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা ছিল । আমিও পাশ পেয়েছিলাম । আরো কয়েকজনের সঙ্গে আমিও বেতারকেন্দ্রের স্টুডিও থেকে অনুষ্ঠান কি করে সম্প্রচারিত হয় ঘুরে দেখেছিলাম । আর একবার সুযোগ পেয়েছিলাম ‘গল্পদাদুর আসরে’ যাবার । তখন ‘গল্পদাদুর আসর’ পরিচালনা করতেন সুকন্ঠ সুদর্শন জয়ন্ত চৌধুরী ।
এখন টেলিভীষনের নানান চ্যানেলের হরেকরকম টক-শো হয়, শিশু-কিশোরদের জন্য হরেকরকম অনুষ্ঠানও হয় । সে সব অনুষ্ঠান দেখে আমরা পুলকিত হই বটে কিন্তু বেতারের সেইসব অনুষ্ঠান মার্জিত ও রুচিশীল সম্প্রচারগুলির কাছাকাছি আসতে পারে বলে অন্তত আমার মনে হয় না । হতে পারে তার একটা কারণ নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, শহুরে- গ্রামীণ সব শ্রেণীর মানুষের জন্য বিনোদনের আর কোন সহজলভ্য মাধ্যম তখন ছিল না । ইন্দিরা দেবীর পরিচালনায় রেডিওর ‘শিশুমহল’ শুনে শৈশব-কৈশোর কেটেছে যাদের তাদের মনে পড়বে প্রতি রবিবার সম্ভবত সকাল সাড়ে ৯টায় ‘শিশুমহল’ শুরু হত, ইন্দিরা দেবীর কন্ঠে ‘কি ছোট্ট সোনা বন্ধুরা, ভালো আছো তো সব ?’ আর একদল কচিকাঁচা সমস্বরে বলত’ ‘হ্যাঁ’ ।
শিশুমহলের ঠিক আগে রবিবার সকাল ৯টায় হত পঙ্কজকুমার মল্লিকের পরিচালনায় ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ । পঙ্কজকুমার মল্লিক ছিলেন বাংলার সঙ্গীত জগতের প্রবাদ পুরুষ এবং বেতার সম্প্রচারের হাত ধরেই পঙ্কজ কুমারের ‘লিজেন্ড’ হওয়া । ১৯২৭এর ২৬শে সেপ্টেম্বর পঙ্কজকুমার প্রথম রেডিওতে গান করেন । এর ঠিক একমাস আগে ২৬শে অগস্ট বেসরকারী উদ্যোগে ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ চালু করে কলকাতার রেডিও সম্প্রচার । প্রতি রবিবার সকাল সাড়ে নটার যে সঙ্গীত শিক্ষার আসরের কথা বলছি, সেটির সম্প্রচার শুরু হয় ১৯২৯ সনের শেষের দিকে । দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে পঙ্কজ কুমার মল্লিক রেডিওর সঙ্গীত শিক্ষার আসরটি পরিচালনা করতেন । ১৯৭৫এর সেপ্টেম্বরে রেডিওর কর্তৃপক্ষ একটা চিঠি ধরিয়ে পঙ্কজ কুমারকে জানালেন যে তাঁকে ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ পরিচালনা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল। কলকাতা রেডিও থেকে পঙ্কজ কুমারের অনাদর বিদায় শিল্পীমহলকেও সেদিন বিচলিত করেছিল ।
রেডিওর আর এক প্রবাদপুরুষ ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । তিনিও শুরু থেকে কলকাতা রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । শুধু যুক্ত ছিলেন বললে কিছুই বলা হয় না, তিনি ছিলেন রেডিওর প্রাণ । আমাদের কৈশোর স্মৃতিতে রেডিও মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । রেডিওর প্রচলন হওয়ার কালে বাঙালির বিনোদন বলতে ছিল নির্বাক চলচ্চিত্র (সবাক হয় ১৯৩১এ), আর কিছু বিত্তবান মানুষের ঘরে কলেরগান বা গ্রামফোন । তিনি কিই নাকরেছেন রেডিওর জন্য । বস্তুত বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হাত ধরেই হয়েছিল বাঙালির বেতার রুচি ও বেতার সংস্কৃতির নির্মাণ, নতুন নতুন বেতার অনুষ্ঠান উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে । তাঁর যোগদানের বছরে ১৯২৮এ শুরু হয় বেতার নাটকের সম্প্রচার । ছেলেবেলার কথা মনে আছে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা ৭-৪৫ থেকে রাত্রি ৯টা পর্যন্ত হত নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রযোজনায় । বাংলার নাট্যইতিহাসের প্রবাদ-প্রতীম সব নাটক রেডিওতে হত ।
সাহজাহান,‘সিরাজদৌল্লা’,‘চন্দ্রগুপ্ত’,‘দুর্গেশ নন্দিনী’, ‘কপালকুন্ডলা’, ‘কবি’, ‘কালিন্দি’ ‘দুই পুরুষ’ ‘প্রফুল্ল’ প্রভৃতি কালজয়ী নাটকের অভিনয় রেডিওতে শুনেছি । মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের দিকপাল অভিনেতারা সেইসব নাটকে অভিনয় করতেন । অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলী, মলিনা দেবী, সরজুবালা, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, মঞ্জু দে, শম্ভূ মিত্র, তৃপ্ত মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়দের বেতার অভিনয় যারা শুনেছেন তাঁরা নিশ্চিতভাবেই এখনও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন । এখনকার নাট্যমাধ্যম শ্রুতি নাটকের যে ধারণা তার উদ্ভব হয়েছে রেডিও নাটকের মধ্য দিয়ে ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরে তাঁর স্থানে আসেন জগন্নাথ বসু ।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৮এর ১৫ই জানুয়ারি বেতার কর্তৃপক্ষ একটি সাহিত্যপত্রিকা (পাক্ষিক না মাসিক মনে নেই) ‘বেতার জগৎ’ প্রকাশনা শুরু করেন । পত্রিকাটিতে থাকতো বেতারের অনুষ্ঠানসূচির সঙ্গে গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি নানান সাহিত্যকর্ম । বেতার গ্রাহকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল পত্রিকাটি । শারদীয়া বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হত । যতদূর জানি ১৯৮৬ সনের পর ‘বেতার জগৎ’এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় ।
গানপাগল আমাদের কাছে খুব জনপ্রিয় ও কাঙ্খিত অনুষ্ঠান ছিল অনুরোধের আসর । রেডিওই ছিল গান শোনার একমাত্র সর্বজনীন মাধ্যম , রেডিওতে শিল্পীরা স্টুডিওতে নিজে এসে গাইতেন অর্থাৎ টাটকা বা লাইভ অনুষ্ঠান, গ্রামফোন রেকর্ডে বাজানো গান । ‘বেতার জগৎ’এ সমস্ত অনুষ্ঠানের সময়সূচি দেওয়া থাকতো গ্রামফোন রেকর্ডের গানের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শিল্পীর নামের পাশে একটা + চিহ্ন দেওয়া থাকতো । এ ছাড়া আকাশবাণীর স্টুডিওতে রেকর্ড করা হত গানের, সেগুলিকে বলা হত ‘রম্যগীতি’ ম দুপুরের দিকে ‘রম্যগীতি’র অনুষ্ঠান হত ।
আকাশবাণীর স্টুডিওতে রেকর্ড করা বহু গান দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গ্রামফোন রেকর্ডে ধ্বনিবদ্ধ হয় । পবল জনপ্রিয় হওয়া পরেশ ধরের কথা ও সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গীত ‘শান্ত নদীটি, পটে আকা ছবিটি’ , ‘ফুলের মত ফুটলো ভোর ভাংলো মাঝির ঘুমের ঘোর’, সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে সবিতা চৌধুরীর ‘হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে’ গানগুলি আদতে রেডিওর রম্যগীতির আসরেই প্রথম প্রচারিত হয় ।
১৯৩১এ মহালয়ার দিন শুরু হয়েছিল কলকাতা রেডিওর কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ । বাণীকুমার এর রচনা, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনা আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চন্ডীপাঠের সেই অনুষ্ঠান বাঙালির দুর্গাপূজা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেল । গ্রাম-শহরের মানুষ অন্তত একদিন দেড়ঘন্টার জন্য রেডিও সোনার জন্য তাদের অকেজো রেডিও সেটটিকে সারিয়ে নিতে রেডিও সারাইয়ের দোকানে হাজির হন । ছিয়াশি বছর পরে আজও টেপ’এ ধরে রাখা সেই অনুষ্ঠান মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হয় । প্রবাদ হয়ে যাওয়া এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলার নেই । বাঙালির কাছে এই অনুষ্ঠানের স্থান কোথায় তা অন্তত একবার বুঝেছিল কলকাতা বেতারের কর্তৃপক্ষ । অনুষ্ঠানে অভিনবত্ব আমদানি করতে চেয়েছিল তারা । বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে না জানিয়ে তারা গোপনে ঠিক করলেন জনপ্রিয় চিত্রাভিনেতা উত্তমকুমার ভাষ্যপাঠ করবেন,সংস্কৃত শাস্ত্রে কৃতিবিদ্য ডক্টর গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের রচনায় । যথা সময়ে মহালয়ার প্রাতে সে অনুষ্ঠান হয়েছিল এবং চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ বা সুপার ফ্লপ । বেতার কেন্দ্রে বিক্ষোভ আর সংবাদপত্রে পাঠকের চিঠি্র পাতাগুলি ভরে গেল সমালোচনায় । প্রবল ক্ষোভের মুখে বেতার কর্তৃপক্ষ বাধ্য হল সে’বছরই মহাষষ্টির সকালে মহিষাসুর মর্দিনীর সম্প্রচার করতে । সেই একবার ,পরের চল্লিশ বছরে এপর্যন্ত এই রকম অপ-সাহস আর হয়নি ।
১৯৪১এর ৭ই অগস্ট এক আশ্চর্য কান্ড ঘটিয়েছিল কলকাতা রেডিও । রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ হয়েছে । তিনি রবীন্দ্রনাথের শোক মিছিলের ধারাবিবরনী সম্প্রচারের ব্যবস্থা করলো । কলকাতা রেডিওর প্রাণপুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই জোড়াসাঁকো থেকে নীমতলা মহাশ্মশান – পুরো শোক-যাত্রার ধারাবিবরনী দিয়েছিলেন । আকাশবাণির সংগ্রহশালায় সেই বিবরনী ধ্বনিবদ্ধ করে রাখা আছে । সেই ধারা বিবরনীর শেষ কয়েকটি পংক্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে – “……ও পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে…।”
এটাই প্রথম কোন ঘটনার টাটকা বিবরণীর সম্প্রসারণ কি না বলতে পারবো না । ফুটবল খেলার ধারা বিবরণী সম্ভবত রেডিওর শৈশবেই শুরু হয়েছিল । আমার রেডিও শোনার শুরু পঞ্চাশ দশক থেকে । যারা খেলার মাঠে যেতে পারতাম না তাদের ভরসার ছিল রেডিও । মনে আছে পঞ্চাশ- ষাটের দশকে ইংরাজিতে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার ধারা বিবরণী দিতেন পিয়ার্সন সুরিটা, সিডনি ফ্রিসকিন, বেরী সরবাধিকারী, দেবরাজ পুরী, শরদিন্দু সান্যাল প্রমুখ । ১৯৫৭ সাল থেকে বাংলায় ফুটবল খেলার ধারাবিবরণি শুরু হয় । ফুটবল ও ক্রিকেটের বাংলা ধারাবিবরণীর ক্ষেত্রে তিনটি নাম প্রবাদের মত হয়ে আছে – তাঁরা হলেন অজয় বসু , পুষ্পেন সরকার,আর কমল ভট্টাচার্য । বছর দুয়েক পরে ক্রিকেট খেলারও বাংলায় ধারাবিবরণী সুরু হয় ।
এখন রেডিওর সঙ্গে আমার এবং অনেকেরই সম্পর্ক নেই বললেই চলে । কেমন আছে সে ? আমার জানা নেই । কলকাতা ক খ গ কি এখনও আছে ? কে জানে ! রেডিও সারাইয়ের কারিগরকেও আর খুঁজে পাই না, অতয়েব মৃত পুরাতন যন্ত্রটি কোথায় পড়ে নিভৃতে ধুলো খাচ্ছে কে জানে আর একটা এফ এম সেট কিনে রবীন্দ্রনাথের গান শুনি আর আঁকড়ে রাখি শৈশব-কৈশোর- তারুণ্য-যৌবনের রেডিও-স্মৃতি । স্মৃতিটুকু থাক !