Homeমুক্তমতবদলিই কি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুক শাহ আলমের মৃত্যুর কারণ? রেজাউল করিম...

বদলিই কি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুক শাহ আলমের মৃত্যুর কারণ? রেজাউল করিম খান

বদলিই কি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুক শাহ আলমের মৃত্যুর কারণ?
রেজাউল করিম খান

একজন মৃত মানুষের জন্য স্বজনদের আহাজারি থেমে গেছে। প্রিয়জনের কান্নার শব্দও আর শোনা যায় না। কিন্তু হঠাৎই কোনও গভীর রাতে বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক বৃদ্ধার মন স্পর্শ করা বিলাপ। নারীকণ্ঠের অস্পষ্ট বিবরণে প্রতিবেশীর চোখের পাতা ভিজে যায়। নির্জন আঁধারে অসহায় প্রতিকারহীনের বেদনা। বুকের ভেতর ক্ষোভের অঙ্কুর। না, এটি কোনো গল্পের সূচনা নয়।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্র্ডের নাটোর অফিসের সহকারী কুক শাহ আলমের মৃত্যুতে এমন দৃশ্যের অবতারণা। পওর বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির ঐ কর্মচারীর বযস হয়েছিল ৫৩ বছর। তার ছেলে মশিউর রহমান একই বিভাগের কার্য সহকারী পদে কর্মরত। গত ৯ই জুন তার ছেলে একটি অফিস আদেশে জানতে পারে, তাকে মৌলভীবাজারে বদলি করা হয়েছে। এই সংবাদে পিতাপুত্র দুইজনই বিস্মিত ও মর্মাহত হয়। ঠিক তার পরদিনই আর একটি অফিস আদেশে জানা গেলো, শাহ আলমকেও বদলি করা হয়েছে কুমিল্লায়। এই চিঠি পেয়ে শাহ আলম ভেঙে পড়ে। কারণ সে বেশ কিছুদিন থেকে অসুস্থ ছিল। একই সময়ে জালাল উদ্দিন নামে অপর একজন অফিস সহায়ককেও ঢাকার হেড অফিসে বদলি করা হয়।

এব্যাপারে তারা নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হানের কাছে আর্জি জানালে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। অতঃপর পিতাপুত্র উভয়ে স্ব স্ব কর্মস্থলে যোগদান করে। কুমিল্লায় গিয়ে শাহ আলম আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করায়। সেখানে তার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। ঐ অবস্থায় সে নাটোরে ফিরে আসে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪শে জুন মারা যায়।
শাহ আলমের স্ত্রী মাসুদা বেগম তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য বদলির ঘটনাকে দায়ী করেন। পুত্র মশিউর রহমান এখনও জানে না, তাদের দুইজনকে কি অপরাধে এমন শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, হেড অফিসের নির্দেশে বদলি করা হয়েছে। তিনি আর কিছুই জানেন না। এব্যাপারে জানার জন্য বাংলাদেশ পানিউন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক জনাব ফজলুর রশিদের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন তোলেন নি। তবে শাহ আলমের বদলির অফিস আদেশপত্রে স্বাক্ষরকারী উপপরিচালক জনাব শেখ মোঃ আব্দুল ওয়াহেদ জানান, ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকুরী প্রবিধানমালা, ২০১৩’ অনুযায়ী সম্ভবত তাকে বদলি করা হয়েছে।

প্রবিধানমালাটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০০০-এর ২৬ ধারার ক্ষমতাবলে প্রণয়ন করা হয়েছে; এর সংজ্ঞার (১) উপধারায় বলা হয়েছে “অসদাচরণ (সরংপড়হফঁপঃ)” অর্থ চাকুরীর শৃংখলা বা নিয়মের হানিকর অথবা কোন কর্মচারী বা ভদ্রজনের পক্ষে শোভনীয় নয় এমন আচরণ এবং নি¤œবর্ণিত আচরণসমূহও ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে : (ক) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসংগত আদেশ অমান্যকরণ; (খ) কর্তব্যে গুরুতর অবহেলা; (গ) কোন আইনসংগত কারণ ব্যতিরেকে কর্তৃপক্ষ বা ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তার কোন আদেশ, পরিপত্র বা নির্দেশের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন ইত্যাদি। প্রবিধানমালার শিরোনামে বলা হয়েছে, এটি ‘কর্মকর্তা ও কর্মচারী চাকুরী প্রবিধানমালা’। কিন্তু বিধানের কোথাও কর্মকর্তাদের বিষয়ে বা বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনও নির্দেশনা নেই। ২০ ধারায় ‘বদলী’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘(১) কোন কর্মচারীকে তাহার লিখিত অনুরোধ বা এই প্রবিধানমালার আওতায় কোনরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও এক কর্মস্থল হইতে অন্য কর্মস্থলে বদলী করা যাইবে…’। অর্থাৎ কর্মকর্তর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অথচ বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস-এর ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘…মন্ত্রীপরিষদ কর্তৃক গৃহীত ও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বদলী সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করা হইয়াছে। এইগুলি নিম্নে প্রদত্ত হইল: ক) তৃতীয় ও চতুর্থ শেণীর বদলীযোগ্য পদে কর্মচারীদেরকে বদলীর প্রয়োজন হইলে প্রথমে তাহাদেরকে একই কর্মস্থলের জন্য অফিসে বদলী করা যাইতে পারে। খ) এ্কই কর্মস্থলে অন্য অফিসে বদলীর সুবিধা না থাকিলে নিকটতম অফিসে বদলী করা যাইতে পারে। গ) তাহাদের বেলায় বদলীর জন্য কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকিবে না।
ঘ) শুধুমাত্র প্রশাসনিক প্রয়োজনেই এই দুই শ্রেণীর কর্মচারীকে বদলী করা যাইবে।

উপরোক্ত সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করিয়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে বদলী করা হইলে উহা অবশ্যই “হয়রানিমূলক” বলিয়া ধরা হইবে এবং এই সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা “অসদাচরণের” সামিল হইবে।’
এ তো গেলো আইন, বিধান, প্রবিধান, প্রজ্ঞাপনের কথা। আমরা সাধারণভাবে জানি, আইন তৈরি হয় মানুষের জন্য। তবে সরকার ‘জনস্বার্থে’ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নানারকম বিধিবিধান তৈরি করে। স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা, সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য রয়েছে পৃথক আইন। বস্তুত, সকলের জন্যই রয়েছে স্ব স্ব আইন ও প্রবিধান। এইরূপ আইন প্রণয়নের পশ্চাতে শীর্ষ আমলাদের সক্রিয় ভূমিকর কথা অজানা নেই। বিশেষ করে প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তারা আজও বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রণীত আইনসমূহের মায়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। তখন ইংরেজ অফিসারগণ ভারতীয় সাধারণ মানুষের সাথে যেমন আচরণ করতেন, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত এখনও তেমনই। আর পেছনের সলতেই তেলের যোগান দিচ্ছে বিদ্যমান আইন, বিধান ও প্রবিধানমালা।
১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের উপর্যুপরি ভয়াবহ বন্যার পর ক্রগ মিশন এর সুপারিশক্রমে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্থান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা) গঠন করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্টপতির ৫৯ নম্বর আদেশে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১৩ সালে প্রণীত বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকুরি প্রবিধানমালার কথা পূর্বেই বলা হয়েছে।

ফিরে আসি নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিষয়ে। মৃত শাহ আলমের স্ত্রী মাসুদা বেগম তার অসহাযত্বের কথা জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষকে। এখন স্বামীর পেনশনের টাকা তিনি নাটোর থেকে পেতে চান আর পুত্র মো: মশিউর রহমানের মৌলভীবাজারে বদলির আদেশ বাতিল। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে বোধকরি এই আবদারটি পূরণ করা বিশেষ কঠিন কিছু নয়।

রেজাউল করিম খান
সাংবাদিক
তারিখ: ০৯/০৮/২১
মোবাইল: ০১৭১১৭৮৯৯৫৫

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments