‘কঠোর লকডাউন’ও সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তাহলে উপায় কী?
– স্বকৃত নোমান
বাংলাদেশে শতভাগ লকডাউন বাস্তবায়ন গত বছরও সম্ভব হয়নি, এই বছরও না। ঢাকাঢোল পিটিয়ে এক তারিখ থেকে ‘কঠোর লকডাউন’ দেওয়া হলো। আমি তো রোজ এক ঘণ্টা সাইকেল চালাই। কঠোরতার ভয়ে চার দিন বের হলাম না। গোল্লায় যাক সাইকেল। পুলিশ না আবার গ্রেপ্তার করে বসে! পঞ্চম দিন জরুরি প্রয়োজনে বাজারে গিয়ে দেখি মানুষ আর মানুষ। মানুষের গায়ের সাথে মানুষ। কী ব্যাপার! লকডাউনে বাজারে এত মানুষ কেন? বুঝলাম যে, আমি আস্ত একটা বোকারাম। মানুষ পুলিশের ভয়ে মেইন রোডে উঠছে না বটে, কিন্তু ঠিকই পাড়ার বাজারে যাচ্ছে, পাড়ার গলিগুঁজি আর চা দোকানে আড্ডা মারছে।
সেনাবাহিনী নামানোর পরও এবারের ‘কঠোর লকডাউন’ও সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। এর কারণ কী? কারণ জনগণের অসচেতনতা। ঠিকঠাক পনের দিন মানুষ ঘরে থাকলেই সংক্রমণের হার কমে যেত। কিন্তু মানুষ ঘরে থাকবে কেন? ঘরে থাকলে দোকানপাটে আড্ডা দেবে কে? চা-সিগারেট খাবে কে? চা-সিগারেট না হয় বাসায় খাওয়া হলো। কিন্তু বাজারে যাবে কে? সদাইপাতি না হয় কাজের লোককে দিয়ে আনানো গেল। কিন্তু মসজিদে নামাজ পড়তে যাবে কে? পাঞ্জেগানা নামাজ না হয় ঘরে বসে পড়া গেল। কিন্তু জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে না গেলে হবে কেমন করে? সুতরাং যত কঠোর লকডাউনই দেওয়া হোক না কেন, ফলাফল জিরো।
জনগণকে সচেতন করার উপায় কী? উপায় হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা। বিজ্ঞানমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করা। সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। প্রকৃত শিক্ষা, বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা, সভ্য নাগরিক আবার কী জিনিস? তাই তো! কী জিনিস? এটা একটা গবেষণার বিষয়। রাজনীতিবিদরা সব কিছু করবে। দরকার হলে মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করে ট্রেন চালিয়ে দেবে। দরকার হলে মহাশূন্যে সুপারশপ বানিয়ে দেবে। দরকার হলে সমুদ্রের মাঝখানে হোটেল-রেস্তোরাঁ খুলে দেবে। কিন্তু জনগণকে প্রকৃত শিক্ষায়, বিজ্ঞানমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে না। তুললে রাজনীতি থাকবে না। থাকলেও রাজনীতি কঠিন হয়ে পড়বে। সহজে লুটপাট করা যাবে না। সহজে দুর্নীতি করা যাবে না। সহজে জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরানো যাবে না। কে চায় নিজের পায়ে নিজে কুঠার মারতে?
সামনে ঈদ আসছে। খবর এলো, ঈদ উপলক্ষে আবার শিথিল হচ্ছে লকডাউনের বিধিনিষেধ। শিথিল না করে উপায়ও নেই। ঈদ-বাণিজ্যের সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত। সুতরাং ফলাফল কী? গত কদিনে লকডাউন দিয়ে যেটুকু অর্জন হয়েছিল, ঈদের আগে লকডাউন শিথিল করার মধ্য দিয়ে সেটুকু সুদে-আসলে পুষিয়ে নেওয়া হবে। মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাবে। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরীতে আবার গাদাগাদি হবে। ভাইরাস আমদানি-রপ্তানি হবে। ঢাকার ভাইরাস সাতক্ষীরায় যাবে, রাজশাহীর ভাইরাস ঢাকায় আসবে, চট্টগ্রামে ভাইরাস সিলেটে যাবে, খুলনার ভাইরাস বরিশাল যাবে। সংক্রমণ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী হবে।
উর্ধ্বমুখী হলে কী হবে? হলে আবার কঠোর লকডাউন দিয়ে দাও। কঠোর লকডাউন কাহাকে বলে? কঠোর লকডাউন বলা হয় গার্মেন্ট ও শিল্প-কারখানা খোলা রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেওয়া। তা এভাবে ‘কঠোর লকডাউন’ চলতে থাকলে কার কী ক্ষতি? ধনবানদের কোনো ক্ষতি নাই। টাকাপয়সা যা আছে অর্ধ শতাব্দি লকডাউন চললেও তাদের কোনে সমস্যা নেই। টাকা ফুরাবে না। ‘বসে বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়’―এই প্রবাদ এখন অচল। আর ক্ষতি নেই সরকারি চাকরিজীবীদের। মাস শেষে তারা তো বেতন পাবেই। তাহলে ক্ষতি কাদের? ক্ষতি লাখ লাখ দিনমুজুরের, ক্ষতি লাখ লাখ শ্রমিকের, ক্ষতি কোটি কোটি নিম্নবিত্তের। তাদের ক্ষতি হলে রাষ্ট্রের কী সমস্যা? কোনো সমস্যা নেই। কিছু ত্রাণ বরাদ্ধ করে দাও, তাতেই সমস্যার সমাধান। ত্রাণে কত দিন চলবে? সেটা আমরা কী জানি? আমাদের কাজ ত্রাণ বরাদ্ধ দেওয়া। আমাদের কাজ আমরা করেছি।
এভাবে চলতে পারে না। কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, বেকারদের হাতশা ক্রমশ বাড়ছে। ঢাকা শহরের বাড়িতে বাড়িতে টু-লেট ঝুলছে। বিস্তর মানুষ স্বর্বস্ব হারিয়ে শহর ছেড়ে গেছে। সবাইকে টিকা দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে স্কুল খুলে দিয়ে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস শুরুর আহ্বান এসেছে জাতিসংঘের দুই সংস্থা ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর তরফ থেকে। এই আহ্বান যৌক্তিক। সমর্থন করছি। একটা প্রজন্মকে এভাবে শেষ করে দেওয়া যায় না। এই ধরনের অকার্যকর লকডাউন কোনো সমাধান আনতে পারবে না।
যে কোনো একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। হয় শতভাগ মানুষকে টিকার আওয়াতায় আনতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে পনের দিনের জন্য কারফিউ জারি করে দিতে হবে। রাস্তায় বের হলেই পাছায় বাড়ি। কোনো কথা নেই। কথা বললেই আবার বাড়ি। ‘মাইরের ওপর ওষুদ নাই।’ অন্যথা স্বাস্থ্যবিধি বাধ্যতামূলক করে সবকিছু স্বাভাবিক করে দেওয়া হোক। যে মরে মরুক, যে বাঁচে বাঁচুক।
মহাকালে রেখাপাত
১২.০৭.২০২১