“সুখের মরন”
নূর হেলেন
এখন আষাঢ় মাস। রাতভর কী ভীষন বৃষ্টি । আকাশে গভীর ঘন মেঘ। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে একফালি মেঘাচ্ছন্ন আকাশ স্পষ্ট তাকিয়ে আছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে, আমি বেলন পিঁড়িতে রুটি বেলছি। পাশের চুলায় তরকারী বলক দিচ্ছে। এখনো বরের অফিসের টিফিন তৈরী করা বাকি। হুলস্থুল করেও, দেয়াল ঘড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে যাই ।
তার ওপর আম্মা সকালে মধু দিয়ে লেবু চা খান। আব্বার নাস্তায় আলু ভাজি মাস্ট। ছেলের বাবার আবার পেঁয়াজ ছাড়া অমলেট লাগে। আর আমি এক কাপ চা সাথে আধখানা রুটি চিবোতে চিবোতে ভাবছি।
কতদিন হলো মন ভরে বৃষ্টিতে ভিজিনা! শেষ কবে ভিজেছিলাম। তাও মনে পড়েনা আর!
ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে দুপুরের কুঁটাবাছা সারলাম। বৃষ্টিতে সবার আবার খিঁচুড়ির আবদার। সাথে চাক করে ভাজা বেগুন আর ভূণা
মাংস। রান্নার ফাঁকে দেখি আবার বৃষ্টি নেমেছে। বারান্দার দড়িতে কাপড়। এক্ষুনি না তুললে সব ভিজে যাবে। কাপড় গুছিয়ে, ঘরদোর গুছিয়ে গোসল সেরে ঘড়ি দেখলাম।
দুপুর দেড়টা।
এই ভর দুপুরেও আমার বারান্দায় অসংখ্য রেইন লিলি মুখ তুলে আছে। ওদের অবশ্য ভিজতে কোনো মানা নেই।
ভরপেট খেয়ে সবাই আলস্যে গড়াগড়ি দিচ্ছে বিছানায়। আমার চোখ জোড়া নিদ্রা শূণ্য। ধীরেধীরে পা ফেলে ঢুকে পড়েছি দুরন্ত কৈশরের দিনে। এমন বিকেলে স্কুল ছুটি হলে ঝালমুড়ি খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। সোঁদা গন্ধে ভরে থাকতো পথ ঘাট। অশান্ত এ শহরের আট তলার বাসায়, সেই চেনা গন্ধ এসে নাকে লাগেনা।
ভাবলাম একবার ছাদে যাবো। হঠাৎ দরজায় অতিথির আগমন। মচমচে করে পাঁকোড়া ভেজে সামনে এনে দিলাম। সাথে আতিথেয়তার অবতার হয়ে হাসিমুখ করে আমিও বসলাম পাশে।
ওদিকে শহরের সব কাক ঘরে ফিরছে। সুর্য্যের পরনেও অস্তগামী লাল শাড়ি।
আজো আমার আর ছাদে যাওয়া হলোনা!
তবুতো ঘড়ি থেমে থাকেনা। কদম কিংবা কামিনীর সুবাসও ওরা চেনেনা।
রাত বাড়ে। ছেলের সাথে ছবি এঁকে, খেলে ধুলে আরেক দফায় কাজের রেল ছুটে চলছে। সারাদিনের বাসি কাঁপড় বেছে রাখলাম। বরের অফিসের শার্ট প্যান্ট আয়রন করাও শেষ। ওর আবার সব কিছু পরিপাটি চাই।
রোজ ঘরে ফিরেই ও চা চায়। তখন রাত আটটার খবর আসে টিভিতে। আম্মার বাতের ব্যাথায় মালিশ করে। আব্বার ইন্সুলিন দিয়ে আসতেই। সময় হয়ে যায় ডিনারের।
দিনশেষে আবারো টেবিল ভরে ওঠে খাবারে। এত ব্যাঞ্জনে কত খাঁটুনি। সেসব নিয়ে ভাবার কারো সময় নেই। তবে যদি এক আধ দিন ঝাল নুন কম বেশি হয়ে যায়। বুনো শেঁয়ালের মতো খেঁকিয়ে ওঠে একেক জন।
সারা দিন করোটা কি তুমি?
খেয়েদেয়ে সিংক ভর্তী থালা বাসনের জঞ্জাল সাঁতরিয়ে বিছানায় আসি। পর্দা সরিয়ে দেখি। কত বড় চাঁদ আজ আকাশে। আজ কি পুর্ণিমা? কি জানি। হবে হয়তো।
আগে জোছনা রাতে কবিতা পড়তাম। শংখ ঘোষের শূণ্যের ভেতরে ঢেউ, অথবা পুর্নেন্দু মৈত্রীর তোমার বিষাদগুলি। কবিতাদের কাছে এখন আমি যদিও ফেরারী। আসামীর মত মুখ লুকিয়ে রাখি বুকশেল্ফের আয়নায়।
আবারো রাত বাড়ে। ছেলেটাকে কোলে চড়িয়ে ঘুম পাড়াই। পা দুটোকে লোহার থামের মতো ভারী মনে হয়। কবরে নামার আগে আর বিরাম নেই এদের। বিছানায় পিঠ ছোঁয়াতেই অনুরাগী হাত, শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে নেয় শরীর। সেখানে অনিচ্ছা বলে কোনো শব্দ নেই!
আমি কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু? নাকি কেউ নই?
নাকি যন্ত্রের অবয়বে বসানো এক মাতৃ হ্রদয়।
না, না, না আমি মানুষ নই। মানুষ নই। আমাকে তোমরা বলো নারী।
হ্যাঁ, আমি নারী।
নারী বলেই বুঝি প্রতি মুহুর্তে আগুনে দগ্ধ হতে হতে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে বলি,
এ মরনেও যে বড় সুখ!
বড় সুখ!
তারপর অতীত অবগুণ্ঠন খুলে দেখি একদিন আমিও ওই তরু গুল্মের মতো বেঁচে ছিলাম!
একদিন আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম, আকাশ ছোঁয়ার!