উইয়ার্ড স্টোরি-০৫ (সিঁড়ির শর্ট স্কার্ট)- তন্ময় ইমরান
সিঁড়ির স্কার্ট সবসময়ই হাঁটুর একটু নিচেই থাকে। তবে প্রায়ই সে যখন বাইরে বের হয়, তখন পাড়ার ছেলেদের মনে হয় আজকের স্কার্টটা হয়তো হাঁটুর উপরেই ছিল। এরপর নানা বয়সী ছেলে-তরুণ-যুবাদের দল সিঁড়ির স্কার্ট কমতে কমতে কবে আরো ছোট হয়ে যাবে, এবং পায়ে ব্যথা পাওয়া বা স্যান্ডেল ছিঁড়ে যাওয়ার ভান করে সেই স্কার্টের ফাঁক দিয়ে নিদেনপক্ষে কিছু অপ্রকাশ্য জিনিস, শারীরিক অংশ ইত্যাদি ইত্যাদি কবে দেখতে পাবে- সেসব নিয়ে প্রথমে আলোচনা, তারপর ফ্যান্টাসির জগতে চলে যায়। তবে পাড়ার ছেলেরা সবাই একমত যে, সিঁড়ি যদি কখনো স্কার্টের নিচে পায়জামা পরতো তাহলে তাকে একদম মানাতো না।
ওদিকে পাড়ার মা-বোন-ঝি-আন্টিদের সিঁড়ির স্কার্টের সাইজ নিয়ে এতো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। ফ্যান্টাসিও নেই। তারা একমত যে, সিঁড়ির পরা সব স্কার্ট অবশ্যই শর্ট এবং সেগুলো কখনোই হাঁটুর থেকে নিচে নামে না। এ থেকে তারা আরও কয়েকটি অনুসিদ্ধান্তে এসেছে এবং একমত হয়েছে। এসব অনুসিদ্ধান্তের একটি হচ্ছে- সিঁড়ির মা, যাকে কিনা এ পাড়ার কেউ কখনো দেখেনি, যিনি কিনা মারা গেছেন বলে লোকে জানে, সেই না দেখা নারী অবশ্যই পরপুরুষের হাত ধরে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন।
তাদের আরেকটি অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে- সিঁড়ির দুদে উকিল বাবা, যিনি কিনা পৈতৃক বাড়ির মায়া ছেড়ে এই মধ্যবিত্তের এলাকা ছেড়ে যাননি, প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত না থাকলেও তিনি একজন মদ্যপ ও নারীলিপ্সু চরিত্রের লোক। সিঁড়িকে কেউ টোন-টোক্কার সাহস পায় না, কারণ তার উকিল বাবার ক্লায়েন্ট হোমড়াচোমড়া রাজনীতিবিদ কিংবা প্রকাণ্ডদেহী আজব লোকজন- যারা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বলেই মালুম হয়ম বা আঞ্চলিক ও জাতীয় মাস্তান এবং বড় বড় গাড়ি-মালিক ব্যবসায়ী যাদের পেশিবহুল বডিগার্ড আছে। যেসব লোকজন প্রতিদিন সিঁড়ির বাবার কাছে আসেন, তাদের একেকজনের গাড়ি এলাকার গলির তুলনায় তো বটেই, কখনো-সখনো গলি পেরিয়ে যে প্রধান সড়ক তার চেয়েও বড় হয়।
তিনতলা বাড়ির দোতলার গ্রিলহীন রেলিংয়ে সকাল-দুপুর-বিকালে বা রাতে সিঁড়ি যখন টিশার্ট পরে ঝুঁকে দাঁড়ায়, তখন দূরে দাঁড়ানো পাড়ার বিভিন্ন বয়সী ছেলেদের ভিন্ন ভিন্ন দল আলাদা আলাদা অবস্থানে দাঁড়িয়ে- বাস্তবে না দেখা গেলেও, মনে মনে ধরে নেয় সিঁড়ির ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে। যথারীতি তাদের ক্লিভেজ সংক্রান্ত জল্পনাও অনেক দূর গড়ায়।
মোটা কাচের ফ্রেম এবং সাদা পায়জামা কিংবা লুঙ্গির ওপর টি-শার্ট পরায় অভ্যস্ত গোবেচেরা মোখলেসের কোনও অবস্থাতেই সিঁড়ির প্রেমে পড়া উচিত ছিল না। কিন্তু অন্য সবার চোখে সিঁড়ির যেমন কাম কিংবা ভোগের ব্যাপার ছিল, মোখলেসের ক্ষেত্রে সে ছিল ভালোবাসা। মোখলেস সিঁড়ির ডেস্পারেট চলাফেরা ভালোবাসতো। সিঁড়িও মোখলেসের মধ্যে হয়তো সেই নিষ্কাম প্রেম দেখেছিল। মোখলেসদের পারিবারিক অবস্থা যতো খারাপই হোক, মোখলেস অদম্য মেধাবী ছেলে এবং এ খবর সিঁড়ি তো বটেই পাড়ার বাইরের পাড়ার এমনকি ছুঁচোমুখওয়ালা সদ্য ব্রণ খুঁচে গর্ত করে ফেলা বখাটেদের দলও জানতো। এ ছেলের হাতে টাকা আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। দুদিন পরেই হয়তো উন্নত কোনও এক দেশে চলে যাবে ফুল স্কলারশিপে। তারপর গবেষক বা বিজ্ঞানী গোছের কিছু হয়ে দেদারসে টাকা কামাবে।
সে যাই হোক, মোখলেসের হাতে সত্যি এরকম একটা স্কলারশিপ এলো। সিঁড়ি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। মোখলেস মাস্টার্সের ফুল স্কলারশিপ পেয়েছে। একদিন পুরো রাত মোখলেস সিঁড়ি-কে ভাবলো। তার মতো ভীরু মানুষের পক্ষে সিঁড়িকে প্রপোজাল দেওয়া সম্ভব না। তবু বারবার সিঁড়ি পায়জামাবিহীন স্কার্টের নিচে নিটোল ফুলের মত পা, বেণী, হাসি, ডেস্পারেট চলাফেরা- তাকে উন্মাদ করে তুললো। সিঁড়ি রাজি থাকলে ওকে বিয়ে করেই সে দেশের বাইরে যাবে। কত কত কঠিন ম্যাথ সে মিলিয়েছে, আর সিঁড়ির অংক মেলাতে পারবে না!
সিঁড়ির ফোন নম্বর ও ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট তার কাছে ছিল। এ পাড়ার অনেকের কাছেই আছে। কেউ সাহস পায়না কিছু বলার। সেরাতে উদভ্রান্ত হয়ে সিঁড়িকে লিখলো- তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। যত বলে, আমি তোমার প্রেমে ততো পড়ি। কাল দুপুরে বারান্দায় দাঁড়াবে!
তারপর নিজের নাম লেখে। পরে ভাবে মেসেজ ফেইসবুকেও দিবে। মেসেজ দেওয়ার চার থেকে পাঁচমিনিটের মাথায় সিঁড়ি ফেইসবুকেই জবাব দেয়। যেন সে অপেক্ষা করেই ছিল- অবশ্যই। আপনাকে আমারও অনেক পছন্দ।
মোখলেস-সিঁড়ির অল্প কিছু মেসেজ চালাচালি হয়। তারা টাইম ঠিক করে সকাল এগারোটায় সিঁড়ি দাঁড়াবে বারান্দায়। মোখলেস ঠিক ওই সময়ে সেখানে যাবে। তারপর চেহারা দেখে দেখে একে অপরকে মেসেজ করে করে কথা বলবে।
রাতের মেসেজিং শেষ করে মোখলেস ঘুমাতে যায়। অনেকক্ষণ ঘুম আসে না। তারপর হালকা তন্দ্রা এলে মেরিলিন মনরোর স্কার্ট ওড়ানো বিখ্যাত ছবির মতো সিঁড়ির স্কার্ট বাতাসে দুলতে দেখে। সারারাত নানা ধরনের স্কার্টের দুলুনি মোখলেসের স্বপ্ন থেকে যায় না। এমন অসসাধারণ অনুভূতি কখনো হয়নি তার। মোখলেসের কাছে মনে হয়, সিঁড়ির নগ্ন পা ভেবে কত ছেলে কতকিছু ভাবে এবং করে, আসলে সেগুলোর মতো বিশুদ্ধ সুন্দর পা আর কয়টা আছে পৃথিবীতে। এতো পবিত্র!
পরদিন মোখলেস ফুল হাতে সিঁড়িদের বাড়ির খুব কাছে চলে যায়। এতোটা কাছে পাড়ার ছেলেরা যায় না। কে জানে সিঁড়ির বাবা কোন গডফাদারকে বলে আবার কী করে বসে!
মোখলেসের হাতে ফুল ছিল। সিঁড়ি দোতলার বেলকনিতে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। সিঁড়ির আজকের টি-শার্টের গলাটা সত্যি বড়। মাঝারি বুকের ভাঁজ দেখা যাচ্ছে মনে হয়। মোখলেস মনে করে, তার তো চোখ প্রায় কানা, এটা মনে হয় চশমার ভুল! সে এগিয়ে যায়। সিঁড়ি গ্যালাক্সির সেরা হাসি উপহার দেয়। ঝকঝকে দাঁত শনির বলয়ের মতো স্বচ্ছ সাদা, গালে মঙ্গল গ্রহের রক্তিম আভা। এসব আরও কী কী যেন মনে হচ্ছিলো মোখলেসের।
ঠিক এ সময়েই মোখলেস বেশ জোরে কেঁপে উঠলো। সে মনে করলো- বোধ হয় অতি উত্তেজনায় মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। কিংবা তার স্ট্রোক হয়েছে। তারপর আরও জোরে সে কেঁপে উঠলো। মোখলেস তাল সামলালো এবং বুঝলো উত্তেজনা নয়- বরং বেশ বড়মাপের ভূমিকম্প হচ্ছে। পাড়ার চারপাশে সোরগোল উঠেছে। ঠিক সেসময়ই সিঁড়ি বাড়ির সিঁড়ি না টপকে আতঙ্কে বেলকনি থেকে ঝাঁপ দিল। আর মোখলেস সে অবস্থাতেও দেখতে পেল তার উড়ন্ত স্কার্ট।
সেদিনের পর সিঁড়ির প্রতি আকর্ষণ কমে গিয়েছিল মোখলেসের। কেননা, ভূমিকম্পের দিন সিঁড়ি স্কার্টের নিচে পায়জামা পরেছিল।