পূজনীয় বকার মা – অতীশ পাল
পূজনীয় বকার মা
বহুকাল আমাদের কোন চিঠি আসে না। অন্তত আমার আসে না। কদিন আগে যাও বা আসতো সবই সরকারি। এখন তাও আসে না। সরকারি নির্দেশ পৌঁছে যায় আমাদের ফোনের মেসেজে বা ইমেলে। আমরা বগল বাজাই আমাদের আত্মশ্লাঘা হয় আমরা আধুনিক বলে, বুঝতে পারি না কখন যেন আমরা ক্রমশ দীন থেকে দীনতর হয়ে যাচ্ছি। আজ বাড়িতে আমার ঘর গোছাতে গিয়ে বহুকালের একটা চিঠি হাতে এল, যেখানে আমাকে সম্বোধন করা হয়েছে পূজনীয় দাদা বলে। যিনি আমাকে পূজনীয় বলে সম্বোধন করেছেন আমি জানি আমি কোন ভাবেই তাঁর পূজ্য নয়। আসলে চিঠি লেখার ভাস্যই ছিল এরকম। আমরা কত শব্দ হারিয়ে ফেলেছি শুধু চিঠি লেখার অভ্যাস হারিয়ে ফেলার কারণে। পূজনিয়েষু, শ্রদ্ধাস্পদেষু, দীর্ঘজীবেষু, সুচরিতাসু,শ্রী চরন কমলেসু, স্নেহাস্পদেসু এরকম আরও অনেক সম্বোধন।
আজ চিঠিতে ওই পূজনীয় শব্দটা পড়ে মনে পড়ে গেল এক মজার সম্বোধনের কথা, ‘ পূজনীয় বকার মা’। সেই সঙ্গে আমার ছোট বেলায় দেখা কয়েকজন মাতালের কথ। গৌর গাঁতাইত ছিল আমাদের পাড়ার এক কমিউনিস্ট মাতাল। আমরা বলতাম গৌরা গাঁতাত।এই গৌরা গাঁতাত কাজ করতেন কলকাতার কোন এক ছাতার কারখানায়, মাসান্তে আসতেন বাড়ি। সিপিএম বা কমিউনিস্ট পার্টির কট্টর সমর্থক। মদ্যপ অবস্থায় আমাদের দু ভাইকে আইসক্রিম (মিষ্টি জলে জমানো বরফ) খাইয়েছেন বেশ কয়েকবার ,কারণ আমার দাদারা ছিল সিপিএম।আমাদের সঙ্গে থাকা সুকুমার সব সময়ই বঞ্চিত হতো বরফ থেকে, কারণ সুকুমারের বাবা ‘কিষ্ট দোলুই’ ছিল কংগ্রেস। গৌরা গাঁতাত মত্ত অবস্থায় তার আঙুলের এক আংটি দেখিয়ে আমাদের বলতেন, ‘জানিস এই আংটির ভেতর বোম লুকিয়ে রেখেছি, সময় হলেই সব শালা কংগ্রেসকে বোম মেরে উড়িয়ে দেব’। এরকম সিপিএম বা কমিউনিস্ট ভক্ত গৌর গাঁতাতও মদ খাওয়ার পর তার কলকাতার নেতাদের বেশ জমিয়ে খিস্তি করতেন। ওই খিস্তি টুকু ছাড়া ওঁকে দেখিনি কোনোদিন মাতলামি করতে।
গৌর গাঁতাতের ছিল একটা বাড়তি ভাঙাচোরা মাটির বাড়ি, আমাদের স্কুলের ফুটবল মাঠের পাশে।সেখানে ভাড়া থাকতেন আমাদের স্কুলের গৌর বাবু তাঁর দুই ছেলে অপুদা আর ঘিন্টুদাকে নিয়ে।আর থাকতেন মৌলভী স্যার তাঁর ছেলে মাসুদ দার সঙ্গে। আমরা যেতাম গৌর বাবুর কাছে পড়তে। অপুদা আর ঘিন্টুদা ছিল আমার চেয়ে বেশ একটু বড়, আমাদের স্কুলেরই ছাত্র। আমার সঙ্গে ঐ দু’ভাই য়ের ছিল খুব বন্ধুত্ব। তখন মোবাইল ফোন আমরা কল্পনাতেও আনিনি, আর ফোন? যেটা কানে লাগিয়ে দূর থেকে কথা বলা যায় তা দেখেছি একমাত্র সিনেমাতে।সে সময় গৌর গাঁতাইত কে তার বৌএর কিছু জানাতে হলে লিখতে হতো চিঠি, আর সে চিঠি লিখে দিত অপুদা। অধিকাংশ সময়ই আমি থাকতাম অপুদার সঙ্গে। আর গৌরা গাঁতাত যখন তার বৌকে চিঠি লিখত সেটারও পাঠোদ্ধার করতো অপু দা বা ঘিন্টু দা। বলাই বাহুল্য গৌরা গাঁতাতের চিঠি লিখে দিত অন্য কেউ।গৌরা গাঁতাতের বড় ছেলের নাম ছিল বকা।
আমার চেয়ে একটু ছোট। একবার গৌরা গাঁতাত তার বৌকে চিঠি লিখেছিলেন, “পূজনীয় বকার মা” সম্বোধনে। এ ঘটনাটা কিন্তু জানাজানি হয়ে যায়, যে কারণে বকা কে সেসময় বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। গৌরা গাঁতাত ছিলেন নিরক্ষর, কিন্তু যিনি ওর হয়ে লিখেছিলেন তিনি ছিলেন কত উঁচু দরের পন্ডিত সেটা ভেবে এখনো অবাক হই। গৌরা গাঁতাত অকালে মারা যায়। সিপিএম অর্থাৎ বামফ্রন্ট তখনও ক্ষমতায় আসে নি।ভাগ্যিস মারা যায়। তাই তার প্রিয় দলটির পচন তাকে দেখে যেতে হয় নি। আমাদের অঞ্চলের সিপিএম নেতাদেরও ভাগ্য ভাল গৌর গাঁতাইতের মত একনিষ্ঠ সিপিএম ভক্ত শ্রমিকের গালাগাল শুনতে হয় নি তাদের। মাতাল গৌর গাঁতাইত মত্ত অবস্থায় তার কলকাতার শ্রমিক নেতাদের খিস্তি করতেন, কারণ তখনই হয়তো গৌরের মতো শ্রমিকের চোখে ধরা পড়েছিল তাদের ভণ্ডামি। আমাদের ছোট বেলায় শহর ধার মানে পুরষোত্তমপুরের চেহারা ছিল একেবারে অন্য রকম ।
এক প্রাচীণ বট গাছের পাশে বোষ্টমের মিষ্টির দোকান। গোপীর বাবা, ‘গৌর বারিক’।গলায় তুলসী মালা,কপালে রসকলি হাতে জপের থলি নিয়ে গৌর বারিক ওখানে নিরামিষ চপ বিক্রি করতেন। সঙ্গে দানাদার, গজা, চিনির মন্ডা জাতীয় কিছু মিষ্টি। উল্টো দিকে হসনা বারিকের সাইকেল সারাইয়ের দোকান আর অমল ভূঞ্যার ধান কোটা কল। এর মাঝ বরাবর একটা রাস্তা দুদিকে বেরিয়ে গেছে। বাস রাস্তার দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ হসনা বারিকের দোকানের পরে রাস্তা ডিঙিয়ে বুলা বারিকের চা,চপের দোকান,তার পাশে ঘনা বারিক। ঘনাও চা চপ বানায়।তবে ওর খ্যাতি চানাচুরে।উল্টো দিকে কেনারাম মাতি( মাইতির) দোকান মুলত চায়ের।তার পাশে ‘ভজা গায়েন’। ভজা গায়েন এক তেলে ভাজার দোকান খুলে কিছু দিনের মধ্যেই খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল তার ‘দো পিঁয়াজি’র কারণে। হসনা বারিক আর কেনারাম মাইতি ছিলেন আমাদের গ্রামের খুব পরিচিত মাতাল।
হসনা বারিককে আমরা কি কারণে যেন চেয়ারম্যান বলতাম। এই চেয়ারম্যান সকালে উঠে দোকানে দুচারটে সাইকেল সারাই করে নটা সাড়ে নটা বাজলেই একটা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন অভিযানে। ছোট চেকের বেশ পরিষ্কার হাফ সার্ট, নিল লুঙ্গী, হাতে স্টিলের চেন লাগানো ঘড়ি এই পোষাকেই ওকে সব সময় দেখেছি। আমরা বলতাম চেয়ারম্যানের অফিস শুরু হলো। চেয়ারম্যানের সম্ভবত দিন শুরু হতো মদ দিয়ে। মদ মানে দিশি চোলাই। গ্রামেই ছিল একই চালায় দুটি চোলাই মদের ঠেক।একই পরিবারের দুজন বিধবা মহিলা মদ বেচে সংসার চালাতেন। তবে ওঁরা মদ চোলাই করতেন না, মদ আসতো বাইরের কোথাও থেকে ফুটবলের ব্লাডের করে। তখন চোলাইয়ের আর এক নাম ছিল ‘ব্লাডার’। পরে যেমন ‘ভাকুর তেল’ নামে চোলাই খ্যাত হয়ে যায়। চেয়ারম্যান বা কেনা মাতি মদ খেতে যেতেন ভিন গাঁয়ে । গ্রামের আর দুই নামকরা মাতাল ছিলেন ‘কালি জানা,’ ও ‘কালি ভুঁইয়া’।
কালি ভুঁইয়ার পোশাকি নাম ছিল ‘চন্ডি’। দুই কালির প্রথম কালি অর্থাৎ কালি জানা কাজ করতেন কলকাতায় কোন এক তেলেভাজার দোকানে আর দ্বিতীয় কালি, চন্ডি ভুঁইয়া ইরিগেশনের জীপগাড়ি চালাতেন। দ্বিতীয় কালি অর্থাৎ চন্ডীবাবু অধিকাংশ সময় নেশা করেই বাড়ি ফিরতেন। অনেক সময়েই ঠোঁটে বিড়ি চেপে হিরোর মতো সরকারি গাড়ি চালিয়েই চলে আসতেন বাড়ি। চন্ডী ভুঁইয়া ছিলেন বেশ সৌখিন মানুষ ছুটির দিনে আদ্দির পাঞ্জাবি পরে গলায় অনেক খানি সাদা পাউডার লাগিয়ে বেশ দাপটের সঙ্গেই গটগট করে ঢুকে যেতেন গ্রামেরই চোলাই এর ঠেকে। আমাদের সময় ক্লাস ফোরের পরীক্ষা হতো বোর্ডের। আমরা দু-তিন মাস স্কুলে রাতে মাষ্টার মশাইয়ের কাছে সেই পরীক্ষার তালীম নিতাম । সে সময় স্কুলেই আমাদের থাকা খাওয়া। কোন কোন রাতে চন্ডীবাবু টং হয়ে এসে যেতেন স্কুলে, মাষ্টার মশাইকে দিয়ে যেতেন বেশ কিছু উপদেশ।
নেশা করলেই চন্ডী বাবু ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করতেন। অবশ্য সবটাই ভুল ইংরেজি। চন্ডীবাবু বুঝিয়ে দিতেন তিনি সরকারি কর্মচারী। হলোই বা ড্রাইভার। সাধারণ এক প্রাইমারী স্কুল মাষ্টারকে তাঁর উপদেশ দেওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা অবশ্য মাঝে মধ্যেই এর শোধ তুলে নিতাম। এই সরকারি কর্মচারী যে সব ছুটির দিনে সন্ধ্যায় নেশা করতেন সে সব দিনে প্রায়ই রাতে বাস রাস্তার ধারে বসে যেতেন লুঙ্গি তুলে। কর্মটি সারার পর যখন পরিমল দোলইয়ের ডোবাতে পরিষ্কার হওয়ার জন্য নামতেন, তখন আমরা ডোবাতে ইট বা পাথর ছুঁড়ে জলে ভিজিয়ে দিতাম চন্ডী বাবু কে। চন্ডী বাবু টলমল পায়ে গালিগালাজ করতে করতে ডোবা থেকে উঠে আসার আগেই আমরা পগারপার। এ বিষয়ে অনুপের লক্ষ্য ছিল প্রায় অব্যার্থ।তাই আমাদের এই নৈশ অভিযানের নেতৃত্ব সব সময়ই থাকতো অনুপ মাইতির হাতে। যাকে আমরা অনা বলেই ডাকতাম। চন্ডী ভুঁইয়া অকালে মারা যাওয়ার সময় তার সরকারি চাকরি সমেত সমস্ত অভ্যাস দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ছেলে ‘স্বপন’কে।
প্রথম কালি অর্থাৎ কালি জানা বাড়ি এলে একটা ধুতি আর আকাশী রঙা সার্ট পরে হাতে ঘড়ি লাগিয়ে সিগারেট কে মুঠোয় বাগিয়ে ধরে টান দিতেন। তা দেখেই আমরা বেশ সমিহ করতাম ওঁকে। কালি জানাও নিজের বাড়ির পাশে চোলাই -এর ঠেকে না গিয়ে মদ্যপান করতে যেতেন ভিন গাঁয়ে। এঁরা গ্রামকে সম্মান জানাতে ভিন গাঁয়ে যেতেন, না নিজেদের মদ্যপান কে আড়াল করতেন তা জানা হয়ে ওঠেনি আজ পর্যন্ত ।
কালি জানাও অকালে মারা যান বেশ বড় একটা সংসার বৌএর ঘাড়ে চাপিয়ে। কালি জানার মেয়ে সন্ধ্যা পড়তো আমাদের সঙ্গে। অসাধারণ ছিল গানের গলা আর অভিনয়ের দক্ষতা। বাবা গত হওয়ার পর হয়তো অভাবের কারণে সন্ধ্যা গ্রাম, মফস্বলে সখের যাত্রায় নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে যেত কয়েকটা টাকার বিনিময়ে। অনেক বদনাম কে সঙ্গী করে সন্ধ্যার বিয়ে হয় এ রকমই এক সখের যাত্রাদলের নায়কের সঙ্গে। পরে শুনেছি সন্ধ্যা সুখী হয়নি , হয়তো হওয়ার কথাও ছিল না। পূজনীয় শব্দটায় মনে এল কত কথা। একটা পূজনীয় শব্দে এই যে জাবর কাটা, একেই কি বলে ‘ভীমরতি’?