Homeসাহিত্যস্মৃতি - তন্ময় ইমরানের গল্প

স্মৃতি – তন্ময় ইমরানের গল্প

উইয়ার্ড স্টোরি-৪ (স্মৃতি)
তন্ময় ইমরান
রাত দুপুরে প্যাঁচার ডাক শুনে ঘুম ভাঙলো মবিনের। অনামিকা যথারীতি আজও পাশে নেই। বছর খানেক আগে এই গহীন জঙ্গলে যখন মবিনের পোস্টিং হয়েছিল- তখন দুইজনেই বেশ খুশি ছিল। মবিনের দায়িত্ব জঙলের ভেতর একটা জরিপ চালিয়ে কতটুকু এলাকাকে সাফারি পার্কে পরিণত করা যায় সেটা যাচাই-বাছাই করা।
মবিন পাশ করেছিল জুওলজিতে। তারপর ইন্টার্ন করেছিল একটা ছোট চিড়িয়াখানায় এবং সে চিড়িয়াখানায় গুটিকয়েক হাড্ডিসার হরিণ, দু চারটা পাখি, চারটা বানর এবং বেশকিছু ঘোড়া ছিল। বাঘ বা সিংহ জাতীয় কিছু ছিল না। সে যাইহোক- চিড়িয়াখানার লোকজনের প্রাণীদের প্রতি অবহেলা দেখে মবিন এ পেশায় জড়াবে না বলেই ঠিক করেছিল। এমবিএ করে ঢুকে পড়েছিল একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কর্মকর্তা হিসেবে।
কিন্তু ভাগ্যের কি অদ্ভুত খেল! সেই ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের মালিক ছিলেন সরকারের প্রভাবশালী। আবার যে বনে মবিন ও অনামিকা এখন থাকছে- সে অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। কাজেই সাফারি পার্কের কথা যখন পাস হয়, তখন তিনি তার ফার্মে থাকা মবিনের জুওলজি ব্যাকগ্রাউন্ড ও এমবিএ ব্যাকগ্রাউন্ড মিলিয়ে তাকেই জরিপ কাজের প্রধান করে ঠিকাদারি বাগিয়ে নিলেন।
মবিনের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না সাফারি পার্ক জিনিসটা কেমন করে চলে, বা তার জন্য জায়গা বাছাই এবং এ সংক্রান্ত জরিপ বা অন্যান্য কিছু কিভাবে করতে হয়- সে ব্যাপারে।
কিন্তু জঙলে আসার এ প্রস্তাব সে ফেলতে পারলো না অনেকগুলো কারণে। প্রথমত, তার বন ও নিরবতা পছন্দ। সারাদিন কাজ শেষে একটা অ্যাডভেঞ্চার বই নিয়ে দিব্যি রাতগুলো কাটিয়ে দেওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, তার বেতন ও সুবিধাদি এতো বেশি ছিল যে শহরে থেকে এ পর্যায়ের স্ট্যাটাস মেইন্টেইন করতে আরো ১০ বছর সময় হয়তো লাগতো। আর তৃতীয়ত, অনামিকাও চাইছিল এমন কোনো প্রাকৃতিক নির্জন পরিবেশে চলে আসতে- কেননা তার কেন বাচ্চা হচ্ছে না আত্মীয় স্বজনের কাছে এ কথা শুনতে শুনতে প্রায় উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিল। প্রায়ই রাতে তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেত যে ঝগড়া বেঁধে যেত।
জঙলের ভেতরে দোতলা এক বাংলোয় প্রায় রাজা-রানির হালেই তারা থাকছে। একটাই অসুবিধা রাত নয়টার পর সে আর অনামিকা একা হয়ে যায়। যদিও সারাদিন বেশ কয়েকজন কাজের মানুষ এবং জরিপের কাজে জড়িত ব্যক্তিদের আনাগোনা থাকে। আবার এই দুজনে মিলে একা হয়ে যাওয়াটা গায়েও লাগে না- কেননা দেড় কিলোমিটার দূরেই বাকিদের একটা অস্থায়ী নিবাস বা কলোনির মত গড়ে তোলা হয়েছে। মবিনের বাইক আছে। কাজেই জরুরী প্রয়োজনে তিন বা চার মিনিটের পথ।
মবিন জানে মধ্যরাতে অনামিকা কোথায় গিয়েছে। সে যেমন ছিল সেভাবেই বিছানা থেকে উঠলো। নগ্ন বলে হাল্কা শীত করছিল আজ। হয়তো দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। তবু গায়ে কিছু জড়ালো না। এখানে দেখার কেউ নেই। অনামিকাও রাতে ইদানিং গায়ে খুব কম কাপড় জড়ায়, কিংবা কখনো কখনো নগ্নই থাকে। কেননা জঙলের একটা ভ্যাপসা গরম মাঝরাত পেরিয়েও বর্ষাকাল কিংবা কখনো সখনো শরৎকালের শেষ অব্দি থাকে। সে গরমটা আবার শহরের মত চিটচিটে ঘামে গা ক্লেদাক্ত করে না।
মবিন ছাদে যায়। পূর্নিমা ছিল। চাঁদ ঢাকা পড়েছে মেঘের আস্তরণে। হাল্কা হলদে আভা আছে। দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এখানে ভোর নাগাদ ঝুম বৃষ্টি নামবে। এসব ভাবতে ভাবতেই অনামিকার দিকে চোখ গেল৷ দুই হাত ঝাপ্টাচ্ছে সে প্যাঁচার মত। মাঝে ডাক দিচ্ছে। ওপর পাশে থাকা সুপারি গাছ থেকেও ডাক আসছে। মবিন ধীরে ধীরে অনামিকার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। অসম্ভব রূপবতী এই মেয়েটাকে সে হারাতে বসেছে। তার ভয় হয়!
মাস দেড়েক আগে অনামিকার এ সমস্যা দেখা দেয়। তার ধারণা সামনের সুপারি গাছে একজোড়া ডাস্কি ঈগল প্যাঁচা যে বাসা বেঁধেছে তারা আসলে তারই বংশধর। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা দুষ্টুমি মনে করলেও মবিন অবাক হয়ে খেয়াল করলো- অনামিকা সত্যি এটা মনে করে। মবিনকে সে প্যাঁচার ভাষায় ডাক দিয়ে শোনালো এবং ওপাশের প্যাঁচারা উত্তর দিল।
উপায় না দেখে মবিন একদিন অনামিকাকে ধর্মীয় বাণী শোনালো- দ্যাখো আমাদের ধর্মে কিন্তু পুনর্জন্ম বলতে কিছু নেই। অনামিকা উত্তর দিল- তাই! তুমি কী মনে করো? মবিন উত্তর দেয়নি।
সন্ধ্যার সময় ডাস্কি ঈগল প্যাঁচারা শিকারে বের হয়, ফেরে বেশ রাত করে। সারাদিন ঘুমায়। কাজেই অনামিকাও তাদের সাথে রাতে কথা বলতেই ছাদে ওঠে। সারাদিন খুব স্বাভাবিক থাকে। আজ যখন অনামিকার পেছনে দাঁড়ালো মবিন- অনামিকা মিনিট তিনেক পর টের পেল৷
ঘুরে একটা লজ্জিত হাসি দিয়ে বললো- জানো কী জিজ্ঞাসা করছে? মবিন চুপ করে থাকলো। অনামিকা বললো- ওরা জিজ্ঞাসা করছে আগের জন্মে তুমিও প্যাঁচা ছিলে কিনা! মনে করতে পারো কিনা!
ইদানিং অনামিকা তার আগের প্যাঁচা জন্মের দু চারটা গল্প বলতে পারে। সাতদিন আগে সে খুব কেঁদেছিল- শিলাবৃষ্টিতে তার ৫টি বাচ্চা প্যাঁচাজন্মে মরে গিয়েছিল সেই স্মৃতি মনে করে। আর দুইদিন আগে রাতে বাংলোর বাইরে শেয়ালের ডাক শুনে কেঁদেছিল কারণ একবার নাকি তার দুটি প্যাঁচা বাচ্চা বাতাসে নিচে পড়ে গিয়েছিল এবং শেয়াল খেয়ে ফেলেছিল!
বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। এবার বেশ কাছে। বিয়ের আগে অনামিকার সাথে সেক্স এবং অ্যাবরশনের স্মৃতি ফিরে এলো মবিনের। তখন বয়স ছিল খুব কম। ঘটনা লুকাতে প্রথমে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল তারা। জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অনামিকার। পরে কেটেই ফেলতে হয়েছিল। এতো সুন্দর মেয়েটা কখনো মাতৃত্বের স্বাদ পাবে না! প্যাঁচাজন্মে দেয়া বাচ্চাদের স্মৃতিচারণ করেই কাটাবে মানবজন্মে!
আবার বিদ্যুৎ চমকালো। নিচে দুটো শেয়ালের অস্তিত্ব টের পেল মবিন। জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে উপরে ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অনামিকাকে বললো- বৃষ্টি এলে ভেতরে চলে এসো। মানব শরীর এই ভোররাতের বৃষ্টি সহ্য করতে পারবে না।
তারপর নিচে নেমে এলো। একেবারে দরজা খুলে হামাগুড়ি দিয়ে শেয়ালগুলোর কাছে পৌঁছালো। যেন সে এক চারপেয়ে জীব ছিল আজীবনই।
অনামিকাকে সে হারিয়ে ফেলবে। কেননা আগের জন্মে মবিন ছিল শেয়াল এবং সেই অনামিকার বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলেছিল! সেকথা অনামিকা নিশ্চয়ই একদিন বুঝতে পারবে কোনো না কোনোভাবে! মায়ের মন বলে কথা।
মবিনকে হামাগুড়ি দিয়ে কাছে আসতে দেখে শেয়ালগুলো ‘হুক্কা হুয়া’ বলে হর্ষ ধ্বনি দিল। যার মানে- আজ ঝড় হবে, পাখির বাচ্চা পড়বে মাটিতে, ভোজন ভালো হবে। মবিনও অবিকল তাদের মতো হুক্কা হুয়া ধ্বনি দিয়ে জঙলে ঢুকলো। সে জানে ভোরের আগে অনামিকা বেডরুমে ফিরবে না। তার আগেই সে চলে আসবে।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments