“বাবা মানে কি?”- নূর হেলেন
‘বাবা’ দুই অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ মাত্র। কিন্তু এই শব্দটির গভীরতা কতখানি তা আমরা সহসা আন্দাজ করতে পারিনা।
নারীরা যেমন জন্মগতভাবেই নিজের অন্তরে গোপনতম প্রকোষ্ঠে ‘মা’ নামক অদৃশ্য এক স্বত্তা পুষে রাখেন। পুরুষের বেলায় সে নিয়ম খাটেনা। পুরুষ শতভাগ বাবা হয় ওঠেন সন্তান জন্মানোর পর। ধীরে ধীরে পিতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করতে করতেই একজন বাবার ভালোবাসার বীজের অংকুরোদগম হতে থাকে।
সেই ভালোবাসার বীজ থেকে নবীন কোমল স্নেহের চারা জন্মায়। তার পর বড় হতে হতে মমতার গাছ। এবং একসময় গিয়ে সে গাছ হয়ে ওঠে আস্থার প্রকান্ড মহীরুহ। জরায়ুর অস্তিত্ব বয়ঃসন্ধিকালে নারীকে জানান দেয় তার মাতৃত্বের ভবিষ্যৎ। কিন্তু শুধুমাত্র পুরুষ থেকে একজন পিতা হয়ে ওঠার ব্যাপারে উঠতি বয়েসী কোনো কিশোরের আকাংখা দেখা যাওয়া বিরল।
হয়তো পুরুষের কাছে প্রেমিক হওয়াটা পিতা হওয়ার চেয়ে সহজ। সাদামাটা একজন যুবক যখন আনাড়ি হাতে তার নবজাতক সন্তানকে কোলে তুলে নেয়। ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে বদলে যেতে শুরু করে তার চারপাশের দৃশ্যপট। সন্তানের মায়াভরা মুখখানি তার চোখে হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী শিল্পকর্ম।
কচি পেলব হাত দুটির স্পর্শকে মনে হয় শুকনো মরুদ্যানে এক টুকরো মিঠা পানির জলাশয়। যত ছুঁয়ে দেই, যত দেখে যাই, তিয়াস যেনো মেটেনা। বাবা হওয়ার পর শুরু হয় তার ভীন্ন এক অভিযান। ভীন্ন এক যাত্রা। মায়ের মতো সে হয়তো দিনমান সন্তানের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে পারেনা।
তার দায়িত্ব তার ব্যস্ততা তাকে সেই অবসরটুকু খুব কমই তৈরী করে দেয়। কিন্তু যেটুকু পায় তাতেই সে পুষিয়ে নিতে চায়, ঠিকঠাক সময় দিতে না পারার অভাব, অপুর্নতা। কেউ কেউ হয়তো এই বাবা নামক ব্যাক্তিটিকে গম্ভীর ব্যাস্ত কিংবা রাগী বলে তাদের ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে ভুল করে।
আসলে বাবাদের সকল ব্যস্ততার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে কিন্তু এই সন্তান আর সংসারের জাগতিক চিন্তা। কিভাবে আরেকটু ভালো থাকা যায়। সবাইকে আরেকটু ভালো রাখা যায়। এই বাবা নামক ব্যাক্তিটি বাসে ঝুলে অফিস যেয়ে অথবা লাঞ্চে শুধুমাত্র চা শিঙাড়া খেয়ে কিছু টাকা বাঁচিয়ে রাখে। যাতে করে সপ্তাহন্তে সন্তান সন্তদি নিয়ে শিশুপার্কে ঘুরতে যাওয়া যায়।
কিংবা ভালো রেষ্টুরেন্টে একবেলা তৃপ্তি ভরে খাওয়া যায়। এক পাঞ্জাবীতে পার করে দেয় ঈদ উৎসব। এক জুতোয় কাটিয়ে দেয় বছর দুয়েক। মায়ের গায়ের গন্ধের সাথে সন্তানরা যতোটা পরিচিত ঠিক ততোটাই অপরিচিত বাবার গায়ের ঘামে ভেজা জামার গন্ধের সাথে। কোথাও না কোথাও যেনো সন্তানের সাথে বাবার একটা খুব সূক্ষ দুরত্বের সুঁতো থেকে যায়। যা না দেখা যায়, না ধরা যায়।
শুধু একান্তে অনুভব যায়। বাবাদের বুকের ভেতর ভালোবাসাময় অনুভূতিগুলো চৌবাচ্চায় জমানো জলের মতো টলমল করে। কিন্তু গলগল করে উপচে পড়ে না। বাবারা সন্তানদের বুকের মাঝে চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলতে পারে না, “সোনামানিক তোকে বড় ভালোবাসিরে”। তারা শুধু নীরবে বুঝিয়ে দেন, ” কোনো চিন্তা নেই, আমি আছি, আমি আছি”।
বাবাদের এই পাশে থাকাটুকু এই ভরসাটুকুই সন্তানের জন্য নির্ভরতার সিঁড়ি। যার ওপর পায়ে ভর দিয়ে তরতর করে তারা সামনে এগিয়ে যায়। তাদের স্বপ্নকে ছূঁয়ে দেয়। সন্তান যত বড়ই হোকনা কেনো, যতো বিখ্যাত হোক না কেনো, যতোই ধনী কিংবা গূণী হোকনা কেনো বাবার কাছে সে প্রথম দিনের মতই এক নবজাতক শিশু। যাকে যে জীবনের প্রতি পদক্ষেপে শিখিয়ে যায় পথ চলার সরল অংকের সুত্রগুলি।
বাবাদের এই অপ্রকাশিত স্নেহের কলিরা সুখপুষ্প হয়ে ফুটে থাকে মনের গহীনে। আর আমৃত্যু চুপিসারে সৌরভ ছড়িয়ে যায় সন্তানের জীবনে। অনেকে বলে বাবা ছায়াদানকারী বট বৃক্ষ। কেউ বলে বাবা তপ্ত খরতাপে ছাতার আশ্রয়।
কেউ বা বলে বাবা বিস্তৃত বিশ্বাস কিংবা মজবুত মনোবল। অথবা পায়ের নিচের শক্ত শেকড়। আসলে সত্যিকার অর্থে বাবা মানে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভালোবাসার নাম। যাকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব, অসম্ভব এবং অসম্ভব।