অতৃপ্তিই আসলে সৃষ্টির মূল – স্বকৃত নোমান
কোনো ঔপন্যাসিক কি কোনো একটা উপন্যাস লিখে তৃপ্ত হয়? মোটেই না। লেখার আগে বা লেখার সময় মনে হয় অসাধারণ কিছু হতে যাচ্ছে। সেটা নিয়ে তার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। নিজেকে বাহবা দেয়, নিজের পিঠ নিজে চাপড়ায়। কিন্তু লেখার পর মনে হয় আস্ত একটা ঘোড়ার ডিম হয়েছে। কিংবা সে যা লিখতে চেয়েছিল তা হয়ে ওঠেনি।
তখন নিদারুণ অতৃপ্তি তাকে আবার অস্থির করে তোলে। সেই অস্থিরতা থেকে তার ভেতর তৈরি হয় নতুন উপন্যাসের ভ্রুণ। কথাশিল্পী আহমাদ মোস্তফা কামাল যেমন বললেন, ‘তবু, তবু একটা মনমতো বাক্য যদি লিখে উঠতে পারি কখনো, যে আনন্দ হয়, তার তুলনা অন্য কিছুতে মেলে না।
নিজেকে তখন অমৃতের সন্তান মনে হতে থাকে।’ আমার কী মনে হয় জানেন কামাল ভাই? মনে হয়, সেই ‘একটা মনমতো বাক্য’ আসলে লেখার বীজ। কৃষক যেমন ফসলের বীজ তুলে রাখে; ধান, আলু, মুলা, তুলা বেগুনের বীজ। ওই ‘মনমতো বাক্যটি’ও বীজ। অমৃত। সেই বীজ তাকে আশাবাদী করে তোলে। মনে হয়, তাকে দিয়ে হবে।
হওয়ার জন্য সে আবার শুরু করে শিল্পের চাষাবাদ। আবার শুরু করে অমৃতের সন্ধান। অতৃপ্তিই আসলে সৃষ্টির মূল। মিথ যেমন বলে, ব্রহ্মা পৃথিবী রচনা করলেন। কিন্তু তৃপ্ত হলেন না। সৃষ্টি করলেন প্রজাপতি দক্ষ। তবু তার তৃপ্তি নেই। সৃষ্টি করলেন মর্তের প্রথম মানব মনুকে। আবার ওদিকে খোদা বললেন, হও। অমনি হয়ে গেল। হয়ে গেল সুন্দর মহবিশ্ব। কিন্তু তৃপ্ত তো হলেন না। অতৃপ্তি থেকেই সৃষ্টি করলেন আদম।
কোনো ঔপন্যাসিক কি কখনো তৃপ্ত হয়েছিলেন? সেই নজির তো পাই না। সবারই একই বেদনা, অতৃপ্তি। হ্যাঁ, হয়েছিলেন এক কবি ফেরদৌসী। ‘শাহনামা’ রচনাশেষে তিনি কী দৃঢ়তার সঙ্গে লিখলেন, ‘এখন এই যশোকীর্তিনামা শেষ হলো। গোটা ধরিত্রীতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার নাম। অতঃপর আমি আর মরবো না, চিরজীবী হয়ে থাকবো। কারণ, বীণার বীজ আমি সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছি।’ ফেরদৌসীর মতো আর কেউ কি আছে, যার ছিল এতটা আত্মবিশ্বাস? জানি না।
আমার মনে হয় যতক্ষণ ঔপন্যাসিকের অতৃপ্তি আছে, ততক্ষণ সে সজীব, সচল, সৃষ্টিমুখর। তৃপ্তি এলো তো তার লেখাও চলে গেল। একই কথা বুঝি প্রেমের ক্ষেত্রেও সত্য। প্রেমিকার প্রতি তৃপ্তি এলো তো, প্রেমিকাকে জীবনের তরে পেয়ে গেল তো প্রেম চলে গেল। অতৃপ্তিই প্রেমকে সজীব রাখে।