Homeমুক্তমতমধ্যযুগে মানবধর্ম জাগরণে চৈতন্যদেবের ভূমিকা - রাজু বিশ্বাস

মধ্যযুগে মানবধর্ম জাগরণে চৈতন্যদেবের ভূমিকা – রাজু বিশ্বাস

মধ্যযুগে মানবধর্ম জাগরণে চৈতন্যদেবের ভূমিকা
রাজু বিশ্বাস

আমরা কথায় কথায় বলি, ‘মধ্যযুগীয় অন্ধকার’। তর্কের খাতিরে আমরা যদি সে কথা মেনেও নিই তবে বলতে হয় আধুনিক এই তড়িতাহত পৃথিবীর মাটি আকাশ অরণ্য কী তার চেয়ে খুব বেশি আলোকিত? যদি তা হত তবে আজকের প্রযুক্তিগর্বিত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম জাতপাত নিয়ে এত উন্মত্ত হত না। প্রতিদিন শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে এত মানুষের প্রাণ যেত না। যে পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে লক্ষ লক্ষ শিশু স্রেফ অনাহারে মারা যাচ্ছে, সেখানে পশু-রক্ষকদের এই সশস্ত্র বর্বর আস্ফালন দেখা যেত না । এই অন্তঃসারশূন্য সভ্যতার গর্ভে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যে বাতাবরন তৈরি হয়েছে তা মধ্যযুগের অন্ধকারকেও লজ্জা দেয়।

বাংলায় ‘মধ্যযুগ’ বলে আমরা যাকে চিহ্নিত করি সেই সময়ের সবচেয়ে বড় সংঘটন হল চৈতন্যদেবের জন্ম (১৪৮৬ অব্দ)। বাংলার সাহিত্য- সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জাগরণ তথা মানবিকতার উন্মেষে তাঁর ভুমিকা অনস্বীকার্য। নিজে বাংলায় বা অন্য ভাষায় কোনও গ্রন্থ রচনা না করলেও তিনি বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্য পর্বের প্রথম প্রাণপুরুষ হয়ে রয়ে গেলেন। তিনি নতুন কোনও ধর্মমতের প্রবর্তকও নন, তবুও তিনি বাংলার আবহমান ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে এক যুগন্ধর স্রষ্টা হিসেবে আপামর বাঙালির হৃৎকমলে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন।  কীভাবে এই অসাধ্য সাধন হল?

তুর্কী আক্রমন পরবর্তী বাংলার রাজনৈতিক পটভূমি আক্ষরিক অর্থেই ছিল বিধ্বস্ত। তেরশ শতাব্দীতে বাংলায় মুসলমান অধিকার শুরু হয়। এ সময় দেশের সামাজিক  সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক অবস্থা  কেমন ছিল তা সহজেই  অনুমেয়। ইলিয়াস-শাহী বংশের স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলায় শান্তি ফিরতে শুরু করে। চোদ্দশ শতকের শেষ দিকে শমসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলায় স্বাধীন সুলতান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ।

এ দেশে তুর্কী আক্রমণের সময়ে চারটি প্রধান ধর্মমত প্রচলিত ছিল,-(১) দেশীয় প্রাচীন ঐতিহ্যবাহিত গ্রামদেবদেবীপূজা (যার মধ্যে বৈদিক দেবতা আছেন, পৌরাণিক দেবতা আছেন, নতুন পরিগৃহীত দেবতাও আছেন।); (২) মহাযান বৌদ্ধ মতের একটি বিশেষ ও স্থানীয় রূপ; (৩) যোগী-মত (যার সঙ্গে শৈব মতের সংস্রব ছিল); এবং (৪) পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যমত (যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিষ্ণু-শিব ও চণ্ডী উপাসনা)। মুসলমান অধিকারের প্রথম দুই তিন শতাব্দীর মধ্যে এই চারটি ধারা মিলে মিশে গিয়ে সাহিত্য প্রবাহিত দুটি প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছিল, – পৌরাণিক  এবং অ-পৌরাণিক। তুর্কী আক্রমণের ফলে বাংলায় কেবল যে ক্ষতিই হয়েছিল, এমনটা নয়; বহিঃশত্রুর আক্রমণ এই দুটি ধারাকে এক হতে সাহায্য করেছিল। তুর্কী জাতির মধ্যস্থতায় বাঙালি জাতির মধ্যে নতুন উদ্যম এবং শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। এই জাতির স্বকীয় সত্তাটি প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। এই নতুন আত্মপ্রত্যয়ী বাঙালি জাতির প্রতিভূ শ্রী চৈতন্যদেব। বাংলার মানবিক ও ধর্মীয় চৈতন্যের উদ্বোধনে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ছিলের প্রথম পথ প্রদর্শক।

চৈতন্য যে ভক্তিরসের ধারা এনেছিলেন ষোল শতাব্দীর শুরুতে, তার কিছু ভুমিকা রচিত হয়েছিল গৌড়-দরবারে রাজকর্মচারীদের দ্বারা ভাগবতের অনুশীলনে। পনেরশ শতাব্দীর শেষ দশকে হোসেন শাহ গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি ধর্ম বিষয়ে উদার চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এক মন্ত্রী  রূপ (গোস্বামী নন) কৃষ্ণলীলা বিষয়ে ‘হংসদুত’, ‘উদ্ভবসন্দেশ’ ইত্যাদি কাব্য রচনা করেন। তাছাড়া বাংলায় চৈতন্য পূর্ববর্তী বৈষ্ণব পদাবলীর বিস্তৃত ভাণ্ডার ছিল। তবে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ –এ সবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল। চৈতন্যদেবের মানসভূমি নির্মাণে এই সব সাহিত্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

চৈতন্য মহাপ্রভু সার্বিক অর্থেই ছিলেন মানবতার পূজারী। বাংলার সমাজেতিহাসে তাঁর মত উদার ব্যক্তিত্ব খুব কমই জন্মেছেন। আমরা এখন যে অর্থে প্রচার কথাটি ব্যবহার করি সে অর্থে চৈতন্য প্রচারক ছিলেন না এবং তিনি কখনও কোনও ধর্ম প্রচার করেননি। ছোটবেলা থেকেই তিনি কবিতা ও সংগীত প্রিয় ছিলেন। শ্লোক ও গানের মধ্যে দিয়ে ভাগবত প্রসঙ্গ তাকে প্রাণিত করত। তিনি ঈশ্বরের কাছে কোনও দিন কিছু চাননি। ভগবানের নাম শুনলে তাঁর মনে অপার প্রেম ও ভক্তিভাবের উন্মেষ ঘটত। আসলে তিনি একটি বিশেষ ধর্মীয় মতবাদকে মানবতাবাদে উন্নীত করতে পেরেছিলেন; এর পিছনে ছিল সব মানুষের প্রতি তাঁর হৃদয়ের অকৃত্রিম প্রেমবোধ। সমাজের কোনও মানুষই তাঁর কাছে অচ্ছুৎ ছিল না। মধ্যযুগের ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্রের’ প্রথম আঘাত হেনেছিলেন শ্রী চৈতন্য। তিনি অনুভব করেছিলেন আবহমানকাল চলে আসা মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণাবোধ, স্পৃশ্য- অস্পৃশ্যের ধারণাকে বদলাতে না পারলে মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়।

চিরকাল ধনীরা ক্ষমতার পূজারী, সমাজের উঁচু নীচু স্তরের মধ্যে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতা নিয়ে ব্যাপক ব্যবধান। এ ছাড়াও মহাপ্রভুর সমকালে অতিরিক্ত দুটি সমস্যা ছিল- এক. গৌড়ের দরবারের প্রভাবে বিদেশী চালচলনের প্রসার, এবং দুই. তার প্রতিবিধানার্থে ব্রাহ্মণদের শুচিতা-গণ্ডীর ক্রমবর্ধমান সংকীর্ণতা ও কঠোরতা। তাছাড়া বহু মানুষ তান্ত্রিক ক্রিয়া কর্ম নিয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত । বাঙালি জাতির এই সমূহ বিপর্যয়ের কালে আলোকবর্তিকা হাতে দাঁড়িয়েছিলেন চৈতন্য। তাঁর ধর্মমতকে হিন্দু ধর্মের কোনও একটি বিশেষ ধারার মধ্যে ফেলে বিচার করলে ভুল হবে, এ কথা ঠিক তিনি ‘বৈষ্ণব ধর্ম’ কে একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন, তথাপি একথাও বলতে হবে যে সেই বৈষ্ণব ধর্ম ছিল মানবতার গঙ্গায় পরিশুদ্ধ এক উদার ধর্মমত। চৈতন্যদেবের মতে ঈশ্বর প্রেম সার্থক হয় মানবতার পূজায়। প্রেমধর্মের মাধ্যমে তিনি প্রচার করলেন বিশুদ্ধ উদার মানবিকতার বাণী। বহুদিন পর যে কথা বলবেন আর এক মহান মনীষী সে কথার খেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন শ্রী চৈতন্য।

‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’- স্বামীজির এই মহান বানীর প্রথম রূপকার ছিলেন শ্রী চৈতন্য। তাঁর মতে চণ্ডালও ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ হতে পারে যদি হরি ভজনা করে। এ কথায় মনে হতে পারে তিনি ‘হরি’ অর্থাৎ বিশেষ এই হিন্দু দেবতাকেই বড় করে তুলতেই বেশি সচেষ্ট ছিলেন, মানবতা প্রচারের উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। কিন্তু গভীরভাবে বিচার করলে বোঝা যায়, চৈতন্যদেব আসলে বহুধাবিভক্ত হিন্দু ধর্মকে উদার আদর্শের মন্ত্রে উদ্বোধিত করে একটি শমিবৃক্ষের নীচে আনতে চেয়েছিলেন, যেখানে মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না; একে অপরের সুখদুঃখের শরিক হবে মানুষ, যেখানে প্রেমই হবে মানুষের একমাত্র ধর্ম।

যখন ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের আস্ফালন, সমাজের নীচু তলার মানুষদেরকে আরও অচ্ছুৎ করে তোলার নগ্ন প্রয়াস, মানুষে মানুষে হানাহানির চরম রূপ প্রকাশ পাচ্ছে, তখন একটি বিশেষ ধর্মমতের আশ্রয় ব্যাতীত চৈতন্যদেবের পক্ষেও সেযুগে মানুষকে বোঝানো সম্ভব ছিল না। ঠিক যে কারণে স্বামীজিকে গেরুয়া বেশ ধারণ করতে হয়েছিল, সেই একই কারণে চৈতন্যকে ধর্মকে আশ্রয় করেই ধর্মের নিগড় ভাঙার চেষ্টা করতে হয়েছিল। কিন্তু লজ্জা, সেই উদার মানবতার আদর্শকে আমরা আজো অন্তরে গ্রহণ করতে পারলাম না।
চৈতন্য নিষ্ঠাবান ঘরের ছেলে, দরিদ্রের সন্তান ছিলেন না, কিন্তু তাঁর মন পরে থাকত গরিব মানুষের কাছে। কোনও ভক্তকে তিনি ধনী করেননি, বরং রঘুনাথ দাসের মত প্রচণ্ড বড় লোকের ছেলেকে তিনি দরিদ্রতম জীবনে অনায়াসে নামিয়ে এনেছিলেন।

 

কিন্তু মানুষ নিজেকে হীন, গরিব- দুঃখী দুর্গত বলে খাটো করবে এ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। শ্রীবাসের বাড়িতে ‘দুঃখী’ নামের এক চাকরানী ছিল, চৈতন্য তার নাম বদলে রেখেছিলেন ‘সুখী’।  ধর্মের নামে আচার বিচারে নিষ্ঠা এবং ভিন্ন মতের প্রতি অ-সহিষ্ণুতা মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছেদ আনে। চৈতন্য মানুষকে খোলা হাওয়ায় চলার ডাক দিলেন, সেখানে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, হিন্দু-মুসলমান, ধনী- গরিব এক হতে দ্বিধাবোধ করেনি।

নবদ্বীপ- শান্তিপুর, নীলাচলে, কাশীতে- যেখানেই তিনি গেছেন হরিনাম সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষকে কাছে টেনেছেন। মানব হৃদয়ের প্রীতি বোধকে জাগরিত করতে চেয়েছেন এবং তিনি অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। তাঁর এই অসামান্য জীবনদর্শন পরবর্তীকালে তাঁর ভক্তদেরকে প্রাণিত করেছিল। জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। সে যুগে এমন মানুষ কেবল বাংলায় নয় সারা বিশ্বেই বিরল ছিল বেঁচে থাকতেই যার জীবনী লেখা হয়েছে।  বাংলা সাহিত্যে জীবনী বা চরিত সাহিত্যের ধারা সর্বপ্রথম চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। মধ্য যুগের দেববাদ শাসিত সমাজে এক মাত্র ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যিনি দেবতার সম্মান পেয়েছিলেন। চৈতন্য পরবরতী বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী বা মঙ্গল কাব্যের ধারায় অন্যান্য পৌরাণিক দেবতাদের সঙ্গে সঙ্গে ‘চৈতন্যবন্দনা’র রেওয়াজ শুরু হয়েছিল।

অধ্যাত্মভাবনায় চৈতন্য ছিলেন অনুরাগের পথের (রাগমার্গ) পথিক। ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের যে নিত্যপ্রেমসম্বন্ধ, সেই সম্বন্ধই পরম সত্য। সেই প্রেম চিত্তে উদ্বুদ্ধ করার পর তা জাগিয়ে রাখাই পরম সাধনা। ভক্তি মুক্তি নির্বাণ – আমি কিছুই চাই না, চাই শুধু তোমাকে, তা তুমি আমাকে যে অবস্থানেই রাখো না ক্যান।-  চৈতন্য রচিত যে আটটি শ্লোক (‘শিক্ষাষ্টক’) পাওয়া গিয়েছে সেখানে এই কথাই বলা হয়েছে ঃ
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীনং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ী।।

‘হে জগতের ঈশ্বর, আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না – না ধন না জন না সুন্দরী নারী না কবি প্রতিভা। আমার জন্মে জন্মে ঈশ্বরের প্রতি নিস্কাম ভক্তি থাকুক।’
মানুষকে মোহ আর লোভ মুক্ত হওয়ার সাধনা যদি ঈশ্বর নামক অদৃশ্য কোনও শক্তিকে আশ্রয় করে সফল হয়ে উঠতে পারে, তবে দোষের কিছু থাকতে পারে না। চৈতন্য এই যুক্তিতেই কৃষ্ণকে আরাধ্য করেছিলেন এবং নিজেকে ভক্তশ্রেষ্ঠা রাধার স্থানে নিয়ে এসেছিলেন। মধুর ভাবের সাধনাই  তাঁর মতে ঈশ্বর প্রাপ্তির সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা। এই মধুর রস তো প্রেমের নির্যাস। যে প্রেম মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, যে প্রেম মানুষের প্রাণে মনুষ্যত্বের উন্মেষ ঘটায়,- চৈতন্য মহাপ্রভু সেই প্রেমের পথের পথিক। এই রক্তক্লান্ত উগ্র ধর্মবাদের যুগে বড় বেশি করে প্রয়োজন তাঁর মত মহামানবকে। ‘মধ্যযুগীয় অন্ধকার’ নয়, মধ্যযুগের এক অসামান্য আলোমানুষের শিক্ষায় আমরা আজো হয়ে উঠতে পারি মানবতার যথার্থ পূজারী।

তথ্য ঋণ :
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)  । সুকুমার সেন । আনন্দ প্রকাশন, ২০০৯ ।
বাংলা সাহিত্য পরিচয় । ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় । তুলসী প্রকাশনী, ২০০৮ ।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments