Homeসাহিত্য"আনন্দ সংসার" - নূর হেলেন এর ছোটগল্প

“আনন্দ সংসার” – নূর হেলেন এর ছোটগল্প

“আনন্দ সংসার”

নূর হেলেন
প্রায় দিন টেবিলে সাধারন ডাল কিংবা আলুভাজি থাকে। সাথে ঝরঝরে ভাত। কোনো কোনো দিন শাহী মোরগ পোলাও। কলি সেসব ভীষণ যত্ন দিয়ে রান্না করে। খাবারের থরে থরে সাজানো থাকে ভালোবাসার আভরণ।
স্বল্প সময়েও নিখুঁত করে আলু পেঁয়াজ কাটে। ডাল বাঁগাড়ের রসুণ বাদামী করে ভাজে। ভর্তায়ও পরিমিত সিদ্ধ থাকে আলু। ডালে হলুদের পরিমাণ যথাযথ। লবণ না চেখেও ও সব ঠিকঠাক সামলে নেয়।
দিনভর উনুনের আঁচে জ্বলে জ্বলে এতো সযতনে ও কী রাঁধে, জানেন?
রাঁধে এক হাড়িভর্তি মায়া!
নিখাঁদ মায়া!
অফিস ফেরত আমি গলা পর্যন্ত খেয়ে যখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। ও তখন আঁচলে কপালের ঘাম মুছে নিয়েও চামচে করে, আরেকটু ভাত তুলে, পাতে দেয়। মনে পড়তেই ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা পানির বোতল আনতে ছুটে যায়। খাবার পর হাত মোছার গামছা এগিয়ে ধরে।
এগুলো ওর রোজকার কাজ।
কাজ নয় আসলে। ওর রোজকার ভালোবাসা।
যা আমি নিত্য দিন বিনাশর্তে পাই।
কিন্তু আজ ও এসবের কিছুই করেনি। পুরো টেবিল শূণ্য। রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়ি উপুড় করা। তেল ঝোলের ঝাঁঝালো গন্ধ নেই কোথাও।
আমাকে দরজা খুলে দিয়ে কলি শোবার ঘরের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে। বাইরে আকাশ কালো করা ধূসর অন্ধকার। এখুনি হয়তো ঝুম বৃষ্টি নামবে।
প্রকৃতির ছল চাতুরী দেখার মতো মন নেই আমার। রাজ্যের কাজ সেরে আমার পেট এখন ক্ষুধায় উন্মাদ। কলির অমন অলস বসে থাকার ছবিটা একদম পছন্দ হলোনা আমার।
রান্না না করার কারন জানতে চাইলাম। শরীর অসুস্থ কিনা। ছোট্ট করে উত্তর দিলো, ভালো লাগছেনা।
আশ্চর্য্য শুধু মাত্র ভালো লাগছেনা দেখে। অসুস্থ না হয়েও আমার স্ত্রী কলি আজকে রান্না করেনি। একজন মানুষ ভালো না লাগার কারনে রান্না বান্না করবেনা। এটা চূড়ান্ত ফাজলামো। আমার পক্ষে এসব মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
আমাকে বলার জন্য ওর উত্তর তৈরীই ছিলো।
– তুমি তো সপ্তাহে দু’দিন ছুটি পাও। শুক্র, শনি। পা টান করে সারা দিন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাও। নয়তো বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে মোবাইলে গেমস খেলে পার করো। আমি কি কখনো সেসব নিয়ে কিছু বলেছি জাহিদ?
– তাহলে তুমি কি চাও কলি, আমি ছুটির দিনেও অফিস করি?
– না সেটা চাইনা। শুধু চাই, আমারো একটা ছুটির দিন হোক। কি রাঁধবো কি বাড়বো এই গঁৎবাঁধা চিন্তারবাইরেও একান্ত নিজের জন্য কিছু সময় থাকুক।
– তার জন্য ছুটি লাগবে কেনো? এরকম কখনো আগে কেউ করেছে? তোমার মা বা আমার আম্মা? কেউ তো করেনি। বরং ছুটির দিনেও তাদের দ্বিগুন কাজ করতে হয়েছে।
– আমি জানি জাহিদ। সে জন্যই তাদের কাজে আনন্দ কম ক্লান্তি বেশি ছিলো। নিজের জন্য তো তাদের কিছু ছিলোনা! নিজেকে উজাড় করে পরের জন্য করেছেন। আর দিন শেষে বিছানায় গিয়ে পেয়েছেন অতৃপ্তির হাহাকার।
কলির কথাগুলো আমি একেবারে ফেলেও দিতে পারছিনা। সত্যিই তো। আমার আম্মা এই শেষ বয়সে এসেও, সেই আগেকার দিনের সব তিক্ত স্মৃতি হাঁতড়ে বেড়ান।
কবে বাড়ির কাজের জন্য নদীর পাড়ে বেড়াতে যেতে পারেন নি। কবে শরৎচন্দ্রের দেবদাস দুই পাতা পড়ে আর বাকিটা পড়ার সুযোগ পাননি। কবে ঝুম বৃষ্টিতে কাঁদাজল ছিঁটিয়ে ইচ্ছেমতো ভিজতে পারেন নি। কবে প্রিয় বান্ধবীর সাথে দু’দন্ড বসে কুলের আঁচার খেতে খেতে গল্প করতে পারেন নি। কবে পছন্দের ডুরে শাড়ি পরে মন ভরে সাজতে পারেন নি।
সব, সব তিক্ত স্মৃতি!
এই সব স্মৃতিরা আম্মাকে আজো কষ্ট দেয়। সে সমস্ত দিনে, হেঁশেলের পোড়া লাকড়ির মতো আম্মার ছোট ছোট চাওয়াগুলোও পুড়ে ছাঁই হয়ে গিয়েছিলো। তবুও আম্মা দায়িত্বের কাছে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো বেঁচে দিয়েছেন।
আমি চাইনা কলিও আম্মার মতো এক বুক আক্ষেপ নিয়ে আমার পাতে ভাত বাড়ুক। হাহাকারের জঞ্জাল আঁকড়ে রাতের পর রাত পার করুক। সংসারের কাজে ওর আনন্দটুকু অন্তত থাকুক। তা না হলে একে আর সংসারইবা বলি কি করে!
আমাকে নিশ্চুপ দেখে কলি এসে পাশে বসলো।
– কি এতো ভাবছো? আচ্ছা চালে ডালে মিলিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিচ্ছি। দ্রুত হয়ে যাবে। সাথে ডিম ভেজে দিবো। চলবে?
ও উঠে যেতে দাঁড়ালো। আমি ওর হাত টেনে ধরে বসালাম।
– আজ থাক। বরং অনলাইনেই কিছু অর্ডার করি। কী সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। তুমিতো অনেকদিন ধরেই বলছিলে টম হ্যাংক্স এর “কাস্ট এওয়ে” দেখবে। চলো আজ এক সংগে দেখি।
বলামাত্রই কলির চোখমুখ কেমন ঝলমল করে উঠলো। সেখানে আর কোনো অভিযোগের পাহাড় দাঁড়িয়ে নেই।
আমার একটা কথা যেনো মুহুর্তেই ওর ভবিষ্যতের সমস্ত আক্ষেপ মুছিয়ে দিয়ে গেলো।
কলি ঠোঁট টিপে মৃদু হাসলো।
উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। বাইরে কী উথাল পাথাল বৃষ্টি নেমেছে। বাতাসে ওর খোলা চুল উড়ছে। ও গ্রিল গলিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জলে হাত ভেজাচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। কী অপার্থিব এক সৌন্দর্য আমার চোখের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে যাচ্ছে।
কলি ঘরে ঢুকতেই দ্রুত হাতে অনলাইলে খাবারের মেন্যু খুঁজতে খুঁজতে ভাবছি।
সংসার তো আক্ষেপের জন্য নয়। সংসার গড়া হয় আনন্দের জন্য।
এই সামান্য কথাটা আমরা ভুলে যাই কেনো!
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments