ভয়াবহ এক মাদক এলএসডি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের আত্মহত্যার ঘটনার তদন্তকারীরা পেয়েছেন ভয়াবহ এক মাদক এলএসডির খোঁজ। এই মাদক সেবনকারী চলে যান এক কল্পনার জগতে ফলে নিজেকে হত্যার চেষ্টাও তাদের কাছে কিছুই মনে হয় না। হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর কারণও এই এলএসডি। তদন্তকারী পুলিশের দেয়া তথ্যমতে বিগত ১৫ মে রাত পৌনে ৮টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এক ডাব বিক্রেতার দা নিয়ে নিজেই নিজের গলা কাটেন হাফিজুর।
ঘটনার সময় তিনি বারবার চিৎকার করে বলছিলেন, “আমাকে মাফ করে দাও”। গলা থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে ঘটনাস্থলেই মারা যান হাফিজুর। বিস্ময়কর এই ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে ভয়ানক এসএসডির তথ্য পায় পুলিশ। জানা যায় অনেক ব্যয়বহুল এ মাদক বিদেশ থেকে দেশে আনা হচ্ছে ও তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে উচ্চবিত্তদের মাঝে। এলএসডি মাদক অনেক পুরোনো হলেও বর্তমানে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পরেছে বাংলাদেশেও। কী এই ‘এলএসডি’ মাদক? লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইডকে সংক্ষেপে বলা হয় এলএসডি। এটি মূলত একটি সাইকেডেলিক ওষুধ, যার রয়েছে অতি উচ্চ মাত্রার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। এটি প্রমোদমূলক ও আধ্যাত্মিক কারণে ব্যবহৃত হয়। এই এসিড ছোট্ট কাগজ, চিনির কিউব বা জিলেটিনে করে বিক্রি করা হয়। অনেকে ইঞ্জেকশনের সাথেও নেয় এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের মতে এলএসডি একটি রাসায়নিক পদার্থ। যা বিভিন্ন শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরনের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি হয়। এটি একটি বর্ণহীন ও গন্ধহীন পদার্থ। এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট ও ক্যাপ্সুল আকারে পাওয়া যায়। এ ধরনের মাদকের প্রভাবে মানুষের মতভ্রম তৈরি হয়। আশেপাশের বাস্তব পরিবেশ ভুলে, মুহূর্তেই চলে যায় অলীক কল্পনার জগতে। এলএসডির আবিষ্কার সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্রথম বিশ্বকে এলএসডির সাথে পরিচয় করে দেন। তিরিশ এর দশকে এরগট নামক এক ধরনের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস এর বিরুদ্ধে কার্যকরী ওষুধ হিসেবে এলএসডি আবিষ্কার করেন তিনি। হফম্যান কম রক্তচাপ, মস্তিষ্কের কার্যকরিতার উন্নতি, শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করার ওষুধ নিয়ে কাজ করার সময় হঠাৎ এলএসডির প্রভাব আবিষ্কার করেন। তখন তিনি নিজেও ভাবেন নি যে এই এলএসডি হবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ মাদক।
১৯৩৮ সালে হফম্যান এর এই আবিষ্কার বিজ্ঞানী বা ফিজিশিয়ান কারো কাছেই তেমন গুরুত্ব পায়নি। ৫ বছর পর ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিজের জিভে স্পর্শ করেই হফম্যান চলে যান স্বপ্নের জগতে। পরের দিন প্রায় দশগুণ বেশি পরিমাণে নিজের জিভে স্পর্শ করান তিনি। ফলাফল ছিলো আগের মতই। তবে এইবার ভয় পেয়ে যান হফম্যান। দ্রুত চিকিৎসক ডেকে নিজের রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস, হার্টরেট সবই পরীক্ষা করেন। ঠিক ছিলো সবই। পরবর্তিতে হফম্যান এর সহকর্মীরা সবাই একে একে এই বর্ণহীন ও গন্ধহীন মাদক পরীক্ষা করেন ও একই ফলাফল পান। মুহূর্তের মাঝেই তারা চলে যান অন্য এক জগতে। আর এভাবেই আবিষ্কৃত হয় এই ভয়াবহ মাদক। কী ঘটে মস্তিষ্কে এলএসডির প্রভাবে? যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের গবেষণা অনুযায়ী, এলএসডি মানব মস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামক রাসায়নিকের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। এ কারণেই সেবনকারীর ব্যবহার, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে ধারণা প্রভাবিত করে। এ মাদক সেবনের পর মানুষ এমন দৃশ্য দেখে যা বাস্তবে নেই। একে বলা হয় ‘হ্যালুসিনেশন’। এই হ্যালুসিনেশনের ফলেই সেবনকারী বা এর আশেপাশের মানুষ অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অনেকেই এই মাদক সেবনের পরে ভালো অনুভব করেন আবার কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে হন বিপদগ্রস্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এর রেকর্ড অনুসারে, এলএসডি সেবনের পর মানুষের রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়াও অনিদ্রা, ক্ষুদামন্দা বা অতিরিক্ত ঘামসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়। ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রে এলএসডিসহ সকল ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়। এর পর ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ চিকিৎসাকাজে এলএসডির ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে এই বিষয়ে গবেষণায় ভাটা পরে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনও মানসিক চিকিৎসায় এলএসডির কার্যকরিতা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।