Homeসাহিত্যপাগল ও কম্বল - দোলনচাঁপা ধর

পাগল ও কম্বল – দোলনচাঁপা ধর

পাগল ও কম্বল
দোলনচাঁপা ধর

পাগলের কম্বলটি হারিয়েছে। এ কথা জানে না এমন লোক কেউ বাকি নেই কারণ পাগল নিজেই সকলকে জানিয়েছে সে কথা। এখন সর্বহারাদের মত কাজলের চায়ের দোকানে বসে আছে গুটিসুটি আর জুলজুল করে চাইছে দোকানে আসা যাওয়া করা প্রতিটি লোকের দিকে যেন তার কম্বলটি ওদের মধ্যেই কেউ নিয়েছে। আগেও অনেক বর্ষা দিনে এমন ভাবেই বসে থাকত এই দোকানে কম্বল বুকে চেপে। কাজল বলে ‘ তোমার ওই রং চটা গুল্লি ওঠা পুরনো কম্বল টা বরং মাথায় দাও ওকে বুকে বেঁধে তুমি ভিজে মর কেন?’ ধোপদুরস্ত সাদা কাপড়ের বাবুরাও বাজার ফিরতি দাঁড়িয়েছিল এই দোকানে কিন্তু পাগলের আর তার কম্বলের বোটকা গন্ধে বৃষ্টিও হার মানতে চাইছে, কেউ কেউ তো ধুত্তোর বলে পথে নামল।

কাজল ক’বার তাড়া দিলেও পাগল নড়ার নয়, মায়া দেখালে ব্যবসা মার খায় আর সে পাগল নয় মোটেই যে এই পাগলকে এই সময়ে আশ্রয় দেবার মত বোকামো করবে। গরম জলের কেটলি তুলে তেড়ে যায় কাজল, পাগল কম্বল দেখিয়ে বলে ‘তবে এইটা অন্তত রেখে দাও’ । এই না হলে পাগল? যার জন্য পাগল হলি যার জন্য তাড়া খাস তাকে বাঁচাতেই মরিয়া। কিন্তু পাগলের এ কথা শুনে এমনকি বৃষ্টিও থেমে গেল । পাগল নেমে গেল তার রোজকার আস্তানায়। ফেলে দেওয়া প্যাকিং বাক্স, বস্তা, ডিমের ট্রে এসবের এক পাহাড় জমিয়েছে, তার উপরেই ওর মানস কৈলাস যেন সকলকে বুঝিয়ে দিতে চায় কত উঁচুতে ও। লোকে ওর ভাব দেখে হাসে, সময়ের সাথে ঝড়েজলে কাগজের পাহাড় পচে, তাই যতবার নতুন প্যাকিং বাক্স পড়ুক না কেন পাগলের উচ্চতা বাড়ে না ও পড়ে থাকে ওর ভাব নিয়ে আর থাকে ওর কম্বল।

এ কম্বল পাগলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, ওর ভয়, ভাবনা, ভালোবাসা সব তাকে ঘিরেই। কম্বল ছাড়া পাগল যেন কখনো ছিল না, কিন্তু কথা হল এ কম্বল পাগল পেল কোথায়? সেই কোন এক দিনে যখন পাগলের নাম হয়ত ছিল রাখাল, তখন সেও এই সাদা জামা পরা বাবুদের মত কারো সংসারে থাকত, পাট করে চুল আঁচড়ে সাদা জামা পরে ইস্কুলে যেত। কত নতুন কথা শুনত বিপ্লবের, গনতন্ত্রের, সমানাধিকারের। সেসব কথা মেনে নিতে পারার বয়স হয়ত তার ছিল না কিন্তু মনে রয়ে গেছিল, গেছিল কারণ প্রিয় মানুষেরা বলেছিল সে কথা। তখন তার রঙিন বয়স রাঙা মন, নিজে ভেসে ভাসিয়েছিল আরও মানুষকে। দুই হাতে ধরা ছিল আরও অনেক হাত, তারা এগিয়েছিল নতুন দিনের পথে। কিন্তু নতুন তো আর চিরনতুন থাকে না, আরও নতুনের জন্য ধরা হাতগুলো ধীরে ধীরে ছেড়ে যেতে থাকে।

একসময় সে একেবারে একা, তার চিরচেনা মানুষেরাও কত বদলে গেছে, তাঁদের মুখেও নতুন কথা। তার পুরনো সংসার তাকে দিল এক পুরনো কম্বল যা তার বরাবর প্রিয় ছিল। প্রিয় মানুষটি চোখ বন্ধ করার আগে কানে কানে বলে গেল ‘ভুলিস না কখনো যা শিখিয়েছি, সে পথেই নতুন দিন’। তারপর কত ঝড় ঝঞ্ঝা, তাই শেখা কথাগুলো কম্বলেই জমা করত সে ভুলে যাবার ভয়ে, বলা তো যায় না সে যে পাগল। পাগল তো আর একবার পাগল হতে পারে না, তাই খুঁজে বেড়ায় তার অরূপ রতন। সকলকে ডেকে বলে ‘তোমরা দেখেছ আমার কম্বল?’ তারা হাসে, পাগলের তাতে কিছু না, সে জানে তাকে খুঁজে পেতেই হবে কম্বল, সব কথা যে তার বুকেই জমা। ওটা ছাড়া নতুন দিন আনবে কি করে সে? রবিবারের চড়া বাজার সেরে বাবুরা চায়ের দোকানে বসেন।

কে যেন বলেছিল পাগল তাড়াতে কম্বলটা সরিয়ে ফেললেই হবে, কম্বল ছাড়া পাগল আর থাকবে না এখানে। এই কাজটি সুনিপুন ভাবে করার জন্য কাজলকে বড় সাবাসী দেন ওঁরা। এদের সুনজরে আর আশ্রয়ে থাকলে কাজলের এই ছোট দোকান বড় হতে কি দেরি হবে? তাই কাজল খুশী। মনের কোনের চোরকাঁটাটা একদিন ঠিক সয়ে যাবে। ওকে অন্তত সব হারিয়ে পাগল হতে হবে না। কম্বলের খোঁজ শেষ হয় না, পাগলের গোঁ বলে কথা। আজ না হোক কাল কম্বল সে খুঁজে পাবেই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments