Homeবিবিধজীবন এক স্বপ্নের নাম -২ - জাহিদুল মাসুদ

জীবন এক স্বপ্নের নাম -২ – জাহিদুল মাসুদ

জীবন এক স্বপ্নের নাম -২
জাহিদুল মাসুদ
নানি যে ঘরে থাকতেন সেই দক্ষিণমুখি ঘরটা ছিল আমার আতুর ঘর। সিলিঙ নেই, বাঁশের তীর ভেদ করে টিনের চাল দেখা যায়। এই ঘরে মাটির চৌকিতে চিত হয়ে শুয়ে হাত পা ছুঁড়ে আমি প্রথম চিৎকার করে কাঁদি। হয়তো পেটের ক্ষুধায়। মা আমার মুখে স্তনের বোটা গুঁজে দেয়,’ কাঁদেনা, কাঁদেনা, ওরে আমার সোনা! কাঁদেনা।’
মাটির চৌকির নিচেই সবাই মাদুর পেতে বসে ভাত খায়, আমার ইয়ানুছ মামা, রাজেদা খালা, ওয়াহেদা খালা। আমার নানি ভাত বেড়ে দেয়। মায়ের বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে ভাত খাওয়ার বয়সে এসে আমিও এখানে বসে ভাত খাই। তখন হয়তো ভাত বেড়ে দেয় রাজেদা খালা। খাই আর দক্ষিণের দরজা দিয়ে উঠান দেখি। চকচকে সাদা উঠোন।
গ্রীষ্মের দুপুরে শহিদুল আর নাজমুলের সাথে গাজির পুকুরে গোসল করতে যাই,পানিতে ঝাপাঝাপি করি। চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত পানি থেকে উঠিনা। কোন কোন দিন নানি পুকুর থেকে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। আবার কোনদিন বান গঙ্গা নদীতে ঝাঁপাঝাপি করতে যাই। ঘাটে বাঁধা দুই স্যালো নৌকার মাঝখানে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি। নৌকার প্রান্তের সাথে থুঁতনিটা গেঁথে গেলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। রাজেদা খালা আমাকে ধরাধরি করে সিংড়া হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোন কোন বিকেলে সিংড়া হাটে যায় ইয়ানুছ মামা। আমরা উঠানে খেলতে খেলতে অপেক্ষায় থাকি, মামা কখন সদাই নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
মামা বাড়ির দক্ষিণ ঘেঁষা একটি ডোবা, তারপরে ফসলি মাঠ। মাঠেরও দক্ষিণে উঁচু সড়ক। আর এদিকে, অর্থাৎ কয়েক বাড়ি উত্তরে বানগঙ্গা নদী। নদীর ওপারে কিছু ঘরবাড়ি। তারও উত্তরে যে ফসলি মাঠ, সেই মাঠের উপর দিয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে ধূ-ধূ করা আমাদের চৌগ্রামের দিকে তাকিয়ে থেকে কতবার ভেবেছি, ‘ঐতো, ধূ ধু করে আমাদের গ্রাম, চৌগ্রাম।’
আমাদের পুবমুখী বাড়িটির মাটির দেয়াল, টিনের চাল, বারান্দা। উত্তরেরটা বড় চাচার দক্ষিণেরটা আমাদের। ৩/৪ বছর বয়সে ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আমি ভাত খেতে বসি।
দাদা প্রায়শই বারান্দা পেরিয়ে দরজায় উবু হয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেন,’আমাক চাড্ড্যা বাত দে বাই।’
আমি দাদার হাত সরিয়ে দিতাম। দাদা আবার হাত বাড়িয়ে দিতেন। শেষ পর্যন্ত আমি যদি তার হাতে কিছু ভাত দিতাম, তিনি খুশি হয়ে আমার কপালে চুমু খেতেন,’ বাইচা থাকো বাই। অনেক বছর বাইচা থাকো।’
মানুষ কখনো নিষ্পাপ হয়না। অল্প হলেও তার দোষ-ত্রুটি থাকেই। তবু কেন যেন আমার দাদা দাদিকে নিষ্পাপ মনে হতো। দাদা যখন মারা গেলেন তখন আমার বয়স মাত্র ৫/৬ বছর। তখন আমিও নিষ্পাপ, নিষ্পাপ চোখেই দাদাকে শেষ দেখা দেখেছি, এজন্যও দাদাকে নিষ্পাপ মনে হতে পারে। আবার তাঁদের সততার কারনেও হতে পারে। দাদা দাদি আমাকে খুব ভালোবাসতেন, কেননা আমি ছিলাম তাঁদের প্রথম নাতি। জুমার দিনে দাদা আমাকে নিয়ে নামাজ পড়তে যেতেন উত্তর পাড়ার মসজিদে, চৌগ্রাম স্কুল পার হয়ে, রাজবাড়ির দীঘির উত্তর পাড়ের মসজিদে।
‘শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করে শির
লিখে রাখো এক ফোটা দিলেম শিশির। ‘
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লাইন দুটো পড়ার সময় আমার এই দীঘিটা মনে আসে। মসজিদের জানালা দিয়ে দীঘিটা দেখা যেত। চৌগ্রাম হাইস্কুলের বারান্দা থেকেও দীঘিটা দেখা যেত।
আমাদের উঠোনে একটা ডালিম গাছ ছিল। দাদা ডালিম পেড়ে আমাকে দিতেন। কোনটা কামড় দিয়ে টক হলে মুখটা বিকৃত করে আমার সাথে মজা করতেন।
আহা!১৯৮৭ সালে দাদা মারা গেলেন। আমার মনে আছে, সে বছর খুব বন্যা হয়েছিল। আমাদের উঠোনে বন্যার পানি উঠেছিল, উঠানে রাখা দাদার লাশের খাটিয়ার কাছাকাছি। নৌকায় করে দাদার লাশ গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই নৌকায় আমিও ছিরাম, দাদাকে আমিও মাটি দিয়েছিলাম। দাদাকে মাটি দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি বারান্দায় বসে দাদির সে কি কান্না!একবার মাটিতে থাপড় মারেন একবার বুকে,’ আমাক একলা থুয়া তুমি কই গেলা?’
দাদির কান্না আর থামে না।
দাদাকে খুব ভালোবাসতেন দাদি। দাদা খুব সুদর্শন ছিলেন, পাকা আমের মতো গায়ের রঙ ছিল। কিছুদিন পরপরই দাদার জন্য খুব কাঁদতেন দাদি। একবার দাদার কথা মনে পড়লে, কাঁদতে কাঁদতে দিন পার করে দিতেন।
নিজের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দাদার স্মৃতিভার পাথরের মতো বয়ে বেড়িয়েছেন দাদি।
দাদার মৃত্যুর পর আব্বাও বেশ মুচড়ে পড়লেন। কাজ কর্মে ঠিকমতো মন বসাতেননা। সংসার অচল হবার যোগাড়। আমাদের চৌগ্রাম বিলে ৪/৫ বিঘা জমি। আবাদ করার জন্য ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করে লাঙ্গলের ভাড়া দিতে পারছিলেননা। কাউকে কিছু না বলে একদিন তিনি বাড়ি থেকে চলে গেলেন। কোথায় গেলেন কেউ তা জানেনা।
একদিন যায়, বাবা আসেনা।
দুই দিন যায়, বাবা আসেনা।
এক সপ্তাহ চলে যায়, বাবা আসেনা।
মা অন্যের বাড়ি থেকে চাউল ধার করে এনে রান্না করেন, আর বাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন উত্তর দিকে, পুকুর পাড়ের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে বাবা কখন বাড়ি ফিরবে।
আমার ছোট ভাই বাচ্চু এবং আমি মাকে জিজ্ঞেস করি,’মা, বাবা কোথায় গেছে? ‘
মা কেবল আঁচল দিয়ে মুখ মোছেন।
প্রায় ১৫/২০ দিন পর বাবা বাড়ি ফিরলেন। বাবা নাকি সিরাজগঞ্জ আমার ছোট চাচার কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বাবা নাকি চাকরি পেয়েছেন। এই খবরে আমাদের খুশি আর ধরেনা। দাদি বাবাকে দেখতে এসে হাত ধরে কেঁদে ফেলেন,’তুই কই গেছিলি বাপ? তোর চিন্তায় আমার জান অস্থির হয়্যা আসে।’ বাবা আমাদের জন্য নতুন পোশাক কিনে এনেছেন। আমরা নতুন পোশাক পরে, নতুন সেন্ডেল পায়ে দিয়ে বন্ধুদের দেখাই আর বলি,’ আব্বা চাকরি পেয়েছেন, আমাদের জন্য এসব কিনে এনেছেন। আমরা সিরাজগঞ্জ চলে যাবো।’
কয়েকদিন পর আমরা সিরাজগঞ্জ চলে গেলাম।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments