একজন বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে
লেখক: পলাশ মজুমদার
এত ভোরে স্বপনের ফোন পেয়ে আমি অবাক। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় আমার স্ত্রী শিউলিও বেশ বিরক্ত। শিউলি জানতে চায়—এই অসময়ে কে ফোন করেছে?
উত্তর না পেয়ে সে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। রিংটোন অফ করে মোবাইল নিয়ে আমি নীরবে চলে যাই ড্রয়িংরুমে।
সাধারণত স্বপনের সঙ্গে আমার কথা হয় রাতে। তা-ও কোনো বিশেষ প্রয়োজনে। ও জানে আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি। একবার ফোন না ধরলে কখনো দ্বিতীয়বার ফোন করে না।
কল ব্যাক করব কি করব না ভাবতেই দ্বিতীয়বার কল আসে। তখন সন্দেহ খেলা করে মনে—স্বপনের কোনো সমস্যা হয়নি তো! আজকাল কত রকমের দুর্ঘটনাই তো ঘটে। নেহাত বিপদে না পড়লে এই সময়ে কেউ কাউকে ফোন করে না। স্বপনের মতো সচেতন মানুষ তো কখনো নয়।
এবার কল রিসিভ করি। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাই স্বপনের স্ত্রী কুসুমের হাউমাউ। কান্না ছাড়া যে কিছু শব্দ আমার কানে আসছে তাতে বুঝতে পারি, স্বপন আত্মহত্যা করেছে কাল রাতের কোনো এক সময়। ওর সাত বছর বয়সী মেয়ে অর্ণির কান্নাও ভেসে আসে।
কল কেটে দিই। কী করব ভেবে পাই না!
বেডরুমে এসে শিউলিকে জোর করে ডেকে তুলি। ঘুমজড়িত কণ্ঠে সে বলে—এত সাতসকালে কী হলো? ডাকছ কেন? কে ফোন করেছে?
কুসুম—আমি বলি।
কোন কুসুম?
স্বপনের বউ কুসুম।
কেন? ওর আবার কী হয়েছে?
স্বপন আর নেই।
নেই মানে?
আত্মহত্যা করেছে।
কখন?
কাল রাতে।
লাফ দিয়ে ওঠে শিউলি। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, কী বলছ এসব!
আমার নিরুত্তর ভাব দেখে শিউলি বলে—আগে থানায় যাও। পুলিশকে ইনফর্ম করো; নইলে নিজে বিপদে পড়তে পারো। পরকীয়া কিংবা দাম্পত্য কলহের কোনো বিষয় হয়তো এর মধ্যে থাকতে পারে। তোমার না জড়ানোটা ভালো হবে। যা করার দূরে থেকে করো।
আচ্ছা। সেটাই করব। শিউলিকে আশ্বস্ত করি।
শিউলির ধারণা আমি আস্ত একটা বোকা। বিপদের সময় চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলি। এর অবশ্য বেশ কিছু প্রমাণ আছে। উত্তর দিলে নিশ্চিত কিছু কথা শুনতে হবে। সে জন্য কথা বাড়াই না।
রাতের টাউজার পরা অবস্থায় শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ওয়ারী থানা বেশি দূরে নয়। স্বপনের বাসাও আমার বাসার কাছাকাছি। রিকশা না পেয়ে হাঁটতে থাকি। অনেকটা দৌড়ানোর মতো।
ওয়ারী থানার ওসি ওসমান গনি আমার বন্ধু আলমগীরের ঘনিষ্ঠ। পরিচয় দেওয়ার পর ওসমান সাহেব এগিয়ে আসেন সহযোগিতায়।
দুইজন পুলিশ নিয়ে ছুটে যাই স্বপনের বাসায়। ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে স্বপন। পুলিশই ধরাধরি করে নামায়। কান্নার জন্য কুসুম কথা বলতে পারছে না। কুসুমকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি—ধৈর্য ধরো। দেখি কী করা যায়।
এরই মধ্যে অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কুসুমের কথা হয়েছে। এসেও পড়েছে কয়েকজন। শোকার্ত পরিবেশ। নারীরা সবাই মিলে কান্না করছে একযোগে। স্বপনের মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন খাটের ওপর।
হঠাৎ কুসুম আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়। বুঝতে পারি এটি সুইসাইড নোট। স্বপনের।
‘শেয়ারবাজার আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। প্রায় এক কোটি টাকা ঋণ। ঋণের সুদও কম নয়। আজ আমি সর্বস্বান্ত। শোধ করার সাধ্য নেই। আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছি না। এই অবস্থায় বেঁচে থেকে কী করব!
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কাউকে যদি দায়ী করতেই হয়, শেয়ারবাজারের রাঘববোয়ালদেরই দায়ী করব। আমার মতো এ রকম হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী। তাদের চরম শাস্তি হোক।’
নোটটি পড়ার পর নিজেকে সংবরণ করতে পারি না। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে স্বপনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সময়ের ঘটনা।
দুই.
আমি আর স্বপন বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তাম। কুসুমও আমাদের সহপাঠী। প্রথম পর্যায়ে আমার প্রতি কুসুমের কিছুটা দুর্বলতা টের পাই। তবে বিভিন্ন কারণে ওর প্রতি আমি অনাগ্রহী ছিলাম। পরবর্তীতে ওর প্রতি স্বপনের মুগ্ধতা দেখে কুসুম নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। আমিও স্বপনকে কুসুমের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলাম।
স্বপনের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্লাসের প্রথম দিন থেকে। মনে আছে, পাশাপাশি বসেছিলাম দুজন। কথায় কথায় জানতে পারি, আমরা এক জেলার মানুষ। তারপর আড্ডা বেশ জমে ওঠে। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। অগণিত রাত-দিন কাটিয়েছি ওর হলে। ওদের মধুখালীর বাড়িতেও গিয়েছি অনেকবার। বাড়ি যাওয়ার সময় ও আমাকে জোর করে নিয়ে যেত। স্বপনের মা-বাবাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
সেই বন্ধুত্ব অটুট থাকে। অথচ কত বন্ধু এলো-গেল। প্রয়োজন শেষে কেটে পড়েছে সবাই। আমাদের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না বলেই টিকে ছিল সম্পর্কটা।
আমার চেয়ে স্বপনের রেজাল্ট ছিল সব সময় ভালো। অথচ ওর চেয়ে বেশি পড়াশোনা করতাম আমি। পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়ার বিরোধী ছিলাম—শুধু সংগীত ছাড়া। ছোটবেলা থেকে আমি গান করতাম। এটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। সংগীত আমার রক্তে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চলত সংগীতচর্চা। স্বপন প্রায়ই আমার গান শুনতে চাইত।
আমার যেকোনো প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত স্বপন। কখনো ওর কাছ থেকে না শব্দটি শুনিনি। স্বপন ছিল স্বাধীনচেতা, যা প্রকাশ পেত ওর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। ছাত্রজীবনে ও প্রায়ই একটি কথা বলত—বন্ধু, আমি বোধ হয় চাকরি করতে পারব না। এটা আমাকে দিয়ে হবে না। কারও হুকুমমতো চলা আমার পক্ষে অসম্ভব।
তখন থেকে স্বপন শেয়ার ব্যবসা করত। ওর বাবার টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। একমাত্র ছেলে বলে স্বপন যখন যা চাইত, বাবা তা বিনা প্রশ্নে পাঠিয়ে দিতেন। এদিকে আমি শেয়ারবাজারের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না। হারতাম ওর প্রতিটি যুক্তির কাছে। তবে ওর বুদ্ধির তারিফ না করে পারতাম না। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলে আমার পড়ার খরচ চালাতেই কষ্ট হতো। শিক্ষাজীবন শেষে একটি চাকরি ছিল পরম আরাধ্য। তখনই ধারণা করেছিলাম স্বপন সব বন্ধুর চেয়ে ভালো করবে।
পড়াশোনা শেষে স্বপন শেয়ারবাজার নিয়েই পড়েছিল। সবাই যখন চাকরি পাওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লাগলাম, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম, কেউ কেউ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, স্বপন কোথাও আবেদন পর্যন্ত করত না। ও ব্যস্ত ছিল শেয়ার ব্যবসা নিয়ে। খুব অল্প সময়ে ফ্ল্যাট-গাড়ি সব করেছিল। ওর সাফল্য দেখে বন্ধুদের অনেকের চোখ টাটাত। কারণ, চাকরি করে যে আমাদের মাস চলতে কষ্ট।
তারপর একদিন শেয়ারবাজারে নামল ধস। একটু একটু করে শেয়ারের মূল্য তলানিতে ঠেকে। আর স্বপনের রক্তচাপ বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে। মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে, এমনকি দেখা করে স্বপন বলত—বন্ধু, বাজার কবে ঠিক হতে পারে? আদৌ কি ঠিক হবে? আমি যে চোখে অন্ধকার দেখছি।
স্টক এক্সচেঞ্জে চাকরি করি বলে আমার কাছে জানতে চাইত স্বপন। আমি সব সময় বিষয়টি এড়িয়ে যেতাম। সত্যি বলতে কি, টাকাপয়সার ব্যাপারগুলো কখনো ভালো বুঝতাম না। চাকরি করার জন্যই কেবল করতাম। সে জন্য পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে পারছি না। আমি শিল্পী মানুষ। গানে মজে থাকি। সুযোগ পেলে ঘুরতে বের হই। ধনদৌলতের প্রতি আগ্রহ নেই বলে পেশাগত উচ্চাকাংখাও নেই।
বৈষয়িক বুদ্ধির অভাব দেখে স্বপন প্রায়ই আমাকে ভর্ৎসনা করত। ও বলত—বন্ধু, তোর জায়গায় আমি হলে এত দিনে অনেক কিছু করে ফেলতাম।
আমি হেসে বলতাম—বন্ধু, আমার খুব বেশি টাকার প্রয়োজন নেই। একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় নির্ভেজাল নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চাই। এত টাকা দিয়ে কী করব! বরং এমনিতে ভালো আছি।
আমার স্ত্রীরও এই নিয়ে দুঃখ নেই। সে কলেজে পড়িয়ে যা পায় তাতে বেশ চলে যায় আমাদের। সংসারে অভাববোধ থাকলেও সুখের কমতি নেই।
আমার মুখে এমন কথা শুনে স্বপন হেসে বলত—তুই আসলে একটা বোকা। তোকে দিয়ে কিছু হবে না।
ওর কথার পিঠে কিছু না বলে চুপ থাকতাম। এই নিরাসক্ত ভাবের জন্যই ও পছন্দ করত আমাকে। তবে সুখী সুখী ভাবের জন্য স্বপন যে গোপনে আমাকে ঈর্ষা করত, তা ঠিক টের পেতাম।
শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের পর আমার সঙ্গে স্বপন বেশ কয়েকবার দেখা করেছিল। পরামর্শ চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, সব শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যা। এই বাজারে থাকা ঠিক হবে না। পারলে অন্য ব্যবসা শুরু কর।
স্বপন বলেছিল, পুঁজি সব শেষ। আর ধারের টাকা? তা কীভাবে শোধ করব? সুদও অনেক। আমার মাথা কাজ করছে না।
আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। ধৈর্য ধরতে বলতাম।
ও বলত—বন্ধু, কত দিন আর ধৈর্য রাখা যায়। আমার যে সব শেষ। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।
দুশ্চিন্তায় আর হতাশায় ওর শারীরিক অবস্থা যে দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিল, তা আমি ঠিক বুঝতে পারতাম। অথচ কী অসম্ভব মনের জোর ছিল ওর! ছাত্রজীবনে কখনো হতাশা প্রকাশ করলে ও আমাকে সাহস জোগাত।
তিন.
সুইসাইড নোট না থাকলে নিশ্চিত ঝড়টা যেত কুসুমের ওপর দিয়ে। তখন হয়তো পুলিশ বলত, দাম্পত্য কলহের কারণে স্বপন আত্মহত্যা করেছে।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কুসুম বারবার বলছে, এবার আমাদের কী হবে? নিজে তো মরে বাঁচল।
আমি কুসুমকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাই না। তাকাতে পারি না ওর মেয়ের দিকে।
সাংবাদিকরা এসে ভিড় জমান। অনলাইন নিউজ পোর্টালে ভাসে—হতাশায় জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা।
দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে গেলে বাদ সাধে পাওনাদাররা। খবর পেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক আসতে থাকে। সবাই নাকি স্বপনের কাছে টাকা পাবে। কেউ দশ লাখ। কেউ পাঁচ লাখ। কেউবা আবার পাঁচ হাজার টাকাও পাবে।
আমি কী করি? কেউ এগিয়ে না আসায় নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিই। পাওনাদারদের বলি, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি আপনাদের পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
আমার মুখে এই কথা শোনার পর স্বপনের আত্মীয়রা কণ্ঠ মিলিয়ে বলে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা তো আছি।
তাদের কথায় আমিও ভরসা পাই। সবার সম্মিলিত আশ্বাসে পাওনাদাররা সেদিনের মতো চলে যায়। সম্পন্ন হয় দাফন।
চার.
কয়েক দিন পর…..
কুসুম আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, আত্মীয়স্বজন কেউ পাশে নেই। অনেকে তার ফোন পর্যন্ত ধরে না। বাড়িভাড়া দিতে পারবে না বলে সে বাপের বাসায় চলে এসেছে।
এদিকে সকাল নেই রাত নেই কেবল ফোন আর ফোন। কয়েকবার ধরার পর আমি আর ফোন ধরি না। এবার আমার অফিস আর বাসায় লোক আসা শুরু করে। স্ত্রী অতিষ্ঠ। অফিসের লোকজন বিরক্ত।
পাঁচ.
মাসখানেক পর আমার কাছে লোক ও ফোন আসা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ জানতে পারি আমাদের ভার্সিটির বন্ধু রতনের কাছে। কুসুম বিয়ে করেছে সোহান নামের তার স্কুলজীবনের এক বন্ধুকে। রতন আরও জানায়, সোহান অনেক টাকার মালিক।
…………………………………………………………………..
গল্প: একজন বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে
লেখক: পলাশ মজুমদার