ছেলেবেলা করি খেলা
কামাল খাঁ
বাড়ির পূর্বদিকে পথ। এরপর ফসলের খোলা মাঠ। আমাদের বাড়ির ভিটেয় ঘর চারটি। চারিদিকে। পশ্চিমে টিনের বড় ঘর। উত্তরে গোয়াল। দক্ষিণে গোলাঘর আর আংশিক শোবার। সব টিনের চাল। কেবল পূবদিকের ঘর আর পাকঘর বাদে। আমরা বলি বাংলাঘর। সব গেরস্থ বাড়িতেই এরকম ঘর থাকতো। এখন আর নেই। আমাদের বাংলা ঘর ছনের তৈরি। দু’বছর অন্তর অন্তর এই ঘরের ছন পাল্টে দিতে হতো। নতুন পুরাণ মিশেল করে ঘরামি এসে গোল্লা তৈরি করে ঘর ছেয়ে দিয়ে যেতো। নতুন ঘরের মজাই আলাদা। বর্ষার আগেই সব ফিটফাট লেপেমুছে। বর্ষা এলেই বিপত্তি । বেড়া, পৈঠা আর ধারি বৃষ্টির ঝাপটায় হতশ্রী। আর দ্বিতীয় বর্ষে কুঁড়েঘরের ছাউনী না টিকলে পুরো বর্ষা বিপত্তির। পানি ঢুকে নাকাল।
যে বাড়িতে কবুতর আছে সে বাড়ির কুঁড়েঘরের চাল টেকা দায়। কবুতর একটা দু’টো করে শলা খুলে খুলে বাসাভর্তি করে ডিম দেবার আগে। আমাদের অনেক কবুতর ছিলো। বড় ভাই পুষতেন। গোলা, কোকা, গিরিবাজ আরো কত কবুতর। বাচ্চার জন্য গোলা কবুতর পোষা হতো। কোকা কবুতেরর ডাক ভিন্ন। আর গিরিবাজ আকাশের অনেক উপরে উঠে ডিগবাজি দেখার মজাই আলাদা। এসব বাদে মাঠভর্তি জালালী কবুতর আসতো ধান কাটার পর। কবুতরের ডাকে ভোর মুখরিত হতো। আর রাতা মোরগের কুক্কুরু-উ-উ-উকুক। ভোরে দু একটা গরুও হাম্বা হাম্বা করে ডেকে উঠতো। আলো ফুটে বের হবার আগেই। বাড়ির বৌ’ঝিরা জেগে উঠতেন। মা জাগতেন, বাবা জাগতেন। নামাজ পড়ে যে যার যতো কাজের রুটিন শুরু হয়ে যেতো। কুয়ো আর কলতলার শব্দে বোঝাযেতো বাড়িটা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। বাড়ির কিষাণ-কামলাগণ ভোরে জেগে গামলায় গরুর পানি ঢালতেন আমাদের কুয়ো থেকে। লাঙ্গলের গরুর যত্ন আগে আগেই হতো ।
ভোরে চাষের কাজে বেরুবে তাই।ছোটবেলায় আমাদের তিনজোড়া গরুর লাঙ্গল দেখেছি। একটা লাঙ্গল মেজভাই চালাতেন। একটা সুধীর। আর একটা ঠিক থাকতো না। যে কেউ। বাবাকে কালে ভদ্রে লাঙ্গল চালাতে দেখেছি। বাড়িতে এইসব কাজ সকলের রপ্তথাকা ভালো। কৃষক ঘরের ছেলেদের নবাবী করতে নেই, ধারণা সকলের এমন। আমাদের বাড়ির ভেতরে বাহিরে দুটো উঠোন। ভেতরের উঠোন আর বাহিরের উঠোন। বইয়ের ভাষায় আঙিনা যাকে বলা হয়। আমাদের আঞ্চলিক উচ্চারণে কোন শব্দই যথাযথ থাকে না। সে সব লেখায় ধারণকরা কঠিন। ভেতরের ছোট উঠোনটা মেয়েদের পর্দা-পুষিদা বজায় রাখতে,কাপড়-চোপড় আর এটা-সেটা শুকাতে ব্যবহৃত হয়। বাহিরের আঙিনা বেশিরভাগ ছেলেদের দখলেই থাকে। কোন কোন সময় কেবল মেয়েরা আসে। শুনেছি আব্বা ব্যবসা করে জমি-জমা ক্রয় করেছেন। পরে নানা কারণে ব্যবসা ছেড়ে জমিজমা ধরে রাখতে কৃষিতেই মনোযোগী ছিলেন। তাই জীবনের আদিও অন্তে কৃষি আমাদের জীবনের সকল সুখ দুঃখ আর আনন্দকে ঘিরে। ( চলবে)