নাটোর নিউজ: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং নাটোরের কয়েকশ সশস্ত্র বিহারী এইদিন রাতে ছাতনী ইউনিয়ন এবং আশেপাশের ১০টি গ্রামে ঢুকে বাড়ি থেকে ঘুমন্ত মানুষদের তুলে চোখ-মুখ বেঁধে ছাতনী স্লুইচ গেটে এনে জড়ো করে। হাফেজ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথমে গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে এবং জবাই করে হত্যা করে।
এরপরে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে এবং যাতে পরিচয় সনাক্ত করতে না পারে সেজন্যে প্রত্যেকের মুখ এসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়া হয়। পরে সশস্ত্র গ্রামবাসী মরদেহ গুলিকে ছাতনী স্লুইচ গেটসহ আশেপাশের পুকুর ও ডোবায় মাটিচাপা দেয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে নাটোরের ছাতনী গ্রামের গণহত্যার সেই ভয়াল, নৃশংস ও হৃদয় বিদারক কথা আজও এলাকার মানুষের স্মৃতিতে দুঃস্বপ্নের মতো দেখা দেয়।
১৯৭১ সালের ৪ জুন হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হন চার শতাধিক বাঙালি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর উত্তরাঞ্চলের হেড কোয়ার্টার ছিল নাটোরে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা নাটোরের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালিয়েছে।
এরমধ্যে নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী গ্রামের গণহত্যা ছিল ভয়াল, নৃশংস ও হৃদয়বিদারক। ছাতনী গ্রামের অবস্থান নাটোর শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমসিএ শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর বাড়ি ছাতনী গ্রামে হওয়ায় এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর অবাঙালিদের বিহারীদের আক্রোশে পড়ে এই এলাকা।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীসহ কয়েকশ বিহারী ৪ জুন গভীর রাতে ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের নাড়িবাড়ি, শিবপুর, পণ্ডিতগ্রাম, বারোঘড়িরা, ভাটপাড়া, আমহাটি, ভাবনি, হাড়িগাছা, রঘুনাথপুর ও বনবেলঘরিয়াসহ ১০টি গ্রামে ঢুকে ঘুমন্ত মানুষদের তুলে হত্যা করে। ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে কিছু লোক বিষয়টি টের পাওয়ায় এলাকার অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পায়। গণহত্যার পর হত্যাকারীরা এলাকায় ফিরে শহীদ মনির সরকারের পুকুরপাড়ে মরদেহের স্তুপ দেখতে পায়। সমস্ত পুকুর রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
যারা ফিরে আসে তারা কয়েকজন মিলে ৫-৬টি করে মরদেহ একসঙ্গে চাপা দিয়ে রাখে। অনেক মরদেহ সনাক্ত করাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যে কথা মনে করে এখনো শিউরে উঠেন গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো। যাদের এতোবড় আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর পরেও সকল পরিবারের সদস্যদের ভাগ্যে জোটেনি আজও কোনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা।
শহীদ পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের আজও মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। শহীদ মনির সরকারের ছেলে দুলাল সরকার জানান, সরকারি কোনো জায়গায় না থাকায় তিনি একটি স্মৃতিসম্ভ তৈরি করার জন্যে জায়গাটি ছেড়ে দেন। পরে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে প্রতিবছর স্থানীয় লোকজন দিবসটি পালন করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালন করার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। সবার নাম সংগ্রহ করতে না পারায় মোট ৬৪ জনের নাম খোদাই করে রাখা হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপ স্থানীয়দের।
এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ছাতনী গণহত্যার দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। সেইসঙ্গে দেশের শুরু হওয়া মানবতাবিরোধীদের বিচারের সঙ্গে ছাতনী গণহত্যার ইন্ধনদাতাদেরও সনাক্ত করে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানান। স্মৃতিস্তম্ভের শহীদের তালিকা দেওয়া আছে তারা হলেন- ছাতনী গ্রামের মনির উদ্দিন সরকার, কালা মিয়া, নূরুজ্জামান, আব্দুল হান্নান, নূর মহাম্মদ, শফিউল্লাহ, আবু বকর, আব্দুল্লাহ মুন্সী, হোসেন পাটোয়ারী, আব্দুল জব্বার, কালা পাল, নিমাই চৌধুরী, শুকুমার চৌধুরী, জসিম উদ্দিন শাহ, আজাহার উদ্দিন শাহ, মনতাজ উদ্দিন শাহ, আবুল কালাম, শাহাবুদ্দিন, কালাম প্রাং, ইসমাইল, ইব্রাহিম, শুটকা, আজাহার, আব্দুর রহমান, কফিল উদ্দিন।
বনবেলঘড়িয়া গ্রামের সেকেন্দার, কোরবান আলী, নরেশ ঠাকুর, কালু মিয়া, সুলতান মিয়া। গোকুলপুর গ্রামের আব্দুস সামাদ, আব্দুল কাদের। পণ্ডিতগ্রামের মনোয়ার হোসেন মনু, ডা. আব্দুল হামিদ, সোনা চৌকিদার, চতু মন্ডল। ভাবনী গ্রামের মেছের প্রাং, শুকবাস মন্ডল, ওসমান শেখ, এছার উদ্দিন হোসেন মন্ডল, কছির উদ্দিন মোল্লা, বাদেশ প্রাং, সুলতান পাটোয়ারী, কেয়ামত মোল্লা, রুহুল আমিন ভূঁইয়া, আছের শেখ, কেকু প্রাং, আব্দুর রহমান, কাঁচু প্রাং।
ছাতনী দিয়াড় গ্রামের আয়ুব আলী মন্ডল, ছাতনী পূর্বপাড়া গ্রামের সৈয়দ আলী মুন্সী, ছাতনী শিবপুর গ্রামের পচাই দফাদার, হামিদ দফাদার, ভাটপাড়া গ্রামের ময়দান মোল্লা, শিবপুর গ্রামের সাধু প্রাং, খলিল মন্ডল, শুকুর প্রাং, হাড়িগাছা গ্রামের কালা চাঁদ, রঘুনাথপুর গ্রামের শুকলাল, বড়গাছা গ্রামের জঙ্গী, আব্দুল জব্বার, জসিম উদ্দিন ও আব্দুল কাশেম। এছাড়া আরো নাম না জানা আরো প্রায় তিনশত শহীদ রয়েছে। ছাতনী গণহত্যায় শহীদ পরিবারের সন্তান দুলাল সরকার জানান, ২০১১-১২ অর্থ বছরে জেলা পরিষদ এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। তবে এখানে আরো সংস্কার প্রয়োজন।
তাই শহীদদের তালিকা করে তাদের মূল্যায়ন করা হোক। স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হয়েছে নতুন প্রজন্ম ১৯৭১ সাল সম্পর্কে জানতে পারবে। সেইসঙ্গে এখানে একটি পাঠাগার তৈরি করা হলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারবে। ছাতনী গণহত্যা দিবস সরকারীভাবে স্বীকৃতির দাবী জানান মুক্তিযোদ্ধারা।