Homeমুক্তমতস্বকৃত নোমানের গল্প 'ঝিনুকের কান্না' : একটি নিজস্ব পাঠ ―রাজু বিশ্বাস

স্বকৃত নোমানের গল্প ‘ঝিনুকের কান্না’ : একটি নিজস্ব পাঠ ―রাজু বিশ্বাস

স্বকৃত নোমানের গল্প ‘ঝিনুকের কান্না’ : একটি নিজস্ব পাঠ
―রাজু বিশ্বাস
কথাসাহিত্যের অনেকগুলি শাখার মধ্যে ছোটগল্প সর্বকনিষ্ঠ। বয়সে ছোটো বলে হয়তো পাঠকের কাছে তার আদর অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথের হাতে ছোটগল্পের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তাঁর হাতেই ছোটগল্প প্রসিদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠা। বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বাংলা ছোটোগল্পকে মহনীয় উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর উত্তরসূরি কৃতি গল্পকাররা। এ ইতিহাস প্রায় সকলের জানা। আধুনিক ছোটগল্পের মধ্যে জীবনের বহুমাত্রিক স্বরকে আজকের লেখকরা তুলে আনছেন নানাভাবে।
কিন্তু প্রায়শই বলতে শোনা যায় এই সময়ের ছোটগল্পে সেভাবে নতুন বিষয়বস্তু উঠে আসছে না। লেখকরা পুরনো জনপ্রিয় বিষয়গুলিকেই নতুন প্রেক্ষাপটে তুলে আনছেন। সেভাবে জীবনকে বিশ্লেষণ করার কোনও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে প্রকাশ পাচ্ছে না। অল্প কিছু গল্পে হয়তো অচেনা জীবন-জীবিকা সমাজ উঠে আসছে যেগুলি তথাকথিত মেধাবী পাঠককে ভাবাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ গল্পই খুব চেনা ছকের। পড়তে শুরু করলে সহজেই শেষটা আন্দাজ করে নেওয়া যায়। কোনও কৌশলকৃত চমকের কথা আমি বলছি না। গল্পে যে বাস্তবতা থাকে তা জীবনেরই প্রতিফলন। গল্পের আদি মধ্য অন্ত্য কোনও ঐন্দ্রজালিক অলৌকিক রহস্য নির্মিত হয় না। তাই পাঠক গল্প পাঠ করতে শুরু করলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে শেষটা তার অভিজ্ঞতার নিরিখে আন্দাজ করে নিতেই পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে লেখকের জীবনকে দেখার দৃষ্টি আরও গভীর ও অনিবার্য হওয়াটাই কাঙ্ক্ষিত। চেনা সাধারণ বিষয় নিয়েই অসাধারণ বহু গল্প লিখেছেন বাংলার গল্পকাররা।
বাংলাদেশের সুপ্রতিষ্ঠিত কথাকার স্বকৃত নোমান উপন্যাসিক হিসেবেই পরিচিত; ছোটগল্প তিনি অবশ্যই লিখেছেন, কিন্তু সংখ্যায় হয়তো অনেক কম। তাঁর সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত একটি গল্প প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার ইচ্ছাতেই মূল আলোচনার আগেই ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়া। তাঁর উপন্যাস পাঠ করে ভালো লেগেছে। উপন্যাসে যে ব্যাপ্তি ও বিস্তার থাকে, জীবনকে সামগ্রিকভাবে তুলে আনার প্রয়াস থাকে তা স্বকৃত নোমানের অনেকটাই করায়ত্ত বলে মনে হয়েছে। কিন্তু ছোটগল্পের সঙ্গে উপন্যাসের বিস্তর ফারাক। এদের মধ্যে কোনও আপাতবিরোধ নেই, বরং নৈকট্যই বেশি; তথাপি এই দুটি শিল্প সংরূপ ভিন্ন। উপন্যাসের কলম আর ছোটগল্পের কলম এক নয়। একই মানুষের মধ্যে ঔপন্যাসিক প্রতিভা আর গল্পকার প্রতিভার সমান প্রতিফলন দেখা যায় না।
রবীন্দ্রনাথও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেই যদি ধরি তবে হুমায়ুন আহমেদ বা ইমদাদুল হকরা যতটা ঔপন্যাসিক, ততোটা ছোটোগল্পকার নন। আবার হাসান আজিজুল হক যত বড় গল্পকার, তত বড় উপন্যাসিক নন। তবে এমনটা কখনোই নয় যে বড় উপন্যাসিক ভালো গল্প লিখতে পারবেন না।
স্বকৃত নোমানের ছোটগল্প আগে পড়িনি, প্রত্যাশাটা অনেক বেশি ছিল। তাঁর সাম্প্রতিক কালে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ (ঢাকা, রবিবার, ৩০ মে, ২০২১) ওয়েবজিনে প্রকাশিত ‘ঝিনুকের কান্না’ গল্পটি আকারে বেশ সংক্ষিপ্ত। গল্পটি যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল, আমার মনে হয়েছে গল্পকার শেষ পর্যন্ত এই গল্পটির প্রতি সুবিচার করেননি। খুব চেনা চরিত্র ও ঘটনাকে প্রথম দিকে বেশ অন্য রকমভাবে উপস্থাপন করে একটা আগ্রহের যায়গা অবশ্যই তৈরি করেছেন; কিন্তু গল্পটিতে যে ব্যাঞ্জনা সৃষ্টির পরিসর ছিল তাকে গল্পের সমাপ্তিতে নিজেই খুন করেছেন লেখক।
গল্পটি উত্তম পুরুষে কথিত। একটি বাসররাতের দৃশ্য দিয়ে গল্পের সূচনা; গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কথক ঝিনুকের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। সে তাঁর প্রথম প্রেমিক তথা স্বামী আদিত্যকে ডিভোর্স দিয়ে অর্থবান সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী খসরু কবিরকে বিয়ে করেছে। কিন্তু বাসররাতে যখন তার প্রত্যাশিত নতুন স্বামীর জন্য অপেক্ষারত, তখন কথকের মনে আদিত্যের স্মৃতি জেগে উঠেছে। সে প্রাণপণে চাইছে মদ্যপ পাগল কবি স্বভাবের আদিত্যকে মন থেকে ঘৃণা করতে, তার অস্তিত্ব সমগ্র সত্তা থেকে মুছে ফেলতে, কিন্তু চেতনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে বারেবারেই সে রোমন্থন করে চলেছে আদিত্যকে। অন্য আর পাঁচটা বস্তুবাদী নারীর মতো সে চেয়েছিল তার স্বামীর প্রচুর অর্থ সম্পত্তি থাকুক।
কিন্তু আদিত্য এমন ছিল না। আদিত্যর একনিষ্ঠ ভালবাসা তাকে বাধ্য করেছিল আদিত্যকে জীবনসঙ্গী রূপে গ্রহণ করতে। আদিত্য মাতাল ছিল, কিন্তু তার ভালবাসায় কোনও খাঁদ ছিল না। সে তার স্ত্রীর প্রতি সম্পূর্ণ লয়াল ছিল। অনেকবার মদ ছেড়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেও সে শেষ পর্যন্ত মদ খাওয়া ছাড়তে পারেনি। তাছাড়া বৈষয়িক উন্নতির দিকে তার কোনও নজর ছিল না। সে কেবল পাগলের মতো ঝিনুকের প্রেমে হাবুডুবু খেতে চাইতো। কিন্তু ঝিনুকের কাছে আদিত্যর এই ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছিল সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর বৈষয়িক সুখের তীব্র নেশা। তাই সে আদিত্যর সঙ্গ ত্যাগ করে খসরু কবিরকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই পর্যন্ত গল্পটি বেশ এগিয়ে চলছিল। কিন্তু গল্পের শেষটা এতোটাই প্রেডিকটেবল যে লেখক তার বাইরে গিয়ে আর নতুন কোনও দিশা দেখাতে পারেননি। যে কারণে গল্পটি শেষ পর্যন্ত কোনও প্রাপ্তবয়স্কদের হালের ওয়েব সিরিজের গল্পের মত মনে হয়েছে। বাসর রাতে নব বধূ যখন নতুন স্বামীর কাছ থেকে রোম্যান্টিকতা মাখা শোহাগ আর প্রেম আশা করেছে যা তার মন থেকে আদিত্যর স্মৃতি চিরতরে মুছে দিতে পারবে, তখন : ”আমার পাশে এসে বসল খসরু। আমি শিউরে উঠলাম। খানিকটা কর্কশ গলায় সে বলল, এখনো তুমি এসব শাড়ি-মাড়ি পরে আছ! খোল খোল। আমি চমকে ওঠি। তার মুখের দিকে তাকাই। তার চোখেমুখে উদগ্র কামনা। যেন তর সইছে না। জড়িয়ে ধরে আমাকে শুইয়ে দিল সে। খুলে ফেলল শাড়ি। ব্রাটা খুলে একটা স্তনে মুখ রাখল। চুষল। গালে কয়েকটা চুমুও খেল। তারপর শুরু করল সঙ্গম।”
একজন নিছক কামুক অবিবেকি মানুষের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েও প্রত্যাশিত সঙ্গম সুখ ঝিনুক পায়নি। কারণ খসরুর যৌন ক্ষমতা ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে। বিছানা থেকে উঠে এসে জানলার ওপারে বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুতের চকিত আলোয় সে দেখতে পায় মদ্যপ আদিত্যকে : ”আমার খুব কান্না পায়। আমি বৃষ্টির মতো কাঁদতে থাকি। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, আমি তোমাকে ভালোবাসি আদিত্য। এই নিরানন্দ মহল থেকে আমাকে তুমি উদ্ধার কর প্লিজ। আমি তোমার কবিতা শুনতে চাই।”
না, উদ্ধারের আর কোনও পথ নেই। আদিত্যর কবিতা এ জীবনে তার আর শোনার সুযোগ হবে না। গল্পের শেষে একটা অনিবার্য মেলানকলিক আবহ সৃষ্টি করলেও গল্পটি শেষ পর্যন্ত সে চেনা ছকেই আটকে থেকেছে। আধুনিক গল্পের পোড় খাওয়া পাঠকরা নতুন কিছু প্রত্যাশা করবেন। চেনা ছক থেকেই লেখকের নিজস্ব জীবনবোধ ও দর্শনে উন্নীত হবার সুযোগ এ গল্পে ছিল; কিন্তু লেখক সেদিকে গেলেন না। বস্তুত এ গল্পের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের গানের অংশ ”এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না…”উদ্ধৃত করে গল্পের ভাবনাটি আগেই ব্যক্ত করে দিয়েছেন লেখক। এ যেন ওই চিরন্তন গানটিরই ভাবসম্প্রসারণ।
লেখক নিজে কখনোই সরাসরি তার গল্পের ব্যাখ্যাতা হন না। যদি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন থাকে, তবে আলাদা কোনও নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি তা করতে পারেন; কিন্তু গল্পের শুরুতেই এমন একটি কবিতা বা গান তিনি ব্যবহার করলেন, যাতে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের ওই তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্যই তিনি গল্পটি লিখছেন। তাহলে আর নতুন কি পেল পাঠক। সুখের জন্য যারা প্রেম চায় তারা কোনোদিন সুখী হয় না বরং পদে পদে অসুখের আগুনে পুড়তে হয়। ঝিনুকের পরিণতির মধ্যে দিয়ে এমনই এক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন লেখক। প্রেম তো চিরন্তন; তার তত্ত্বও চিরন্তন হবে তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু গল্পকারের উপস্থাপন কৌশলের গুনে পাঠক গল্পটি থেকে নতুনভাবে রসগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু নোমান এ গল্পে পরিচিত চৌহদ্দির বাইরে বেরোতে পারেননি। হতে পারে এটা তাঁর গল্প লেখার নিজস্ব কৌশল। কিন্তু সাধারণ পাঠকের প্রত্যাশা তাতে পূর্ণ হয় না। তাছাড়া ছোটগল্পে ভাষা ব্যবহারে যে সংযমবোধ প্রয়োজন তা এ গল্পে অনুপস্থিত।
যৌনতার দৃশ্যগুলি সরাসরি বর্ণনা না করেও দিব্যি গল্পের বিশেষ সিচুয়েসনগুলি বুঝিয়ে দেওয়া যেত, তাতে গল্পের ব্যঞ্জনা আরও বৃদ্ধি পেত। কিন্তু এখানেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। জনপ্রিয়তার কথা ভাবলে এক শ্রেণির পাঠক যৌন দৃশ্যের বিস্তারিত বর্ণনা বেশি পছন্দ করেন, কিন্তু পর্ণগ্রাফি আর সাহিত্য কখনোই এক হতে পারে না। সাহিত্যে যৌনতার অবাধ প্রয়োগ থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা যদি অনিবার্য হয় এবং সেটার প্রয়োগের মধ্যে যদি লেখকের অন্য বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য থাকে।
এ গল্পে যতটুকু যৌন দৃশ্যের বর্ণনা আছে তাকে আরও সংহত করার সুযোগ ছিল। আমি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হবার কারণে ব্যক্তিগতভাবে স্বকৃত নোমানের খুব বেশি লেখা পড়ার সুযোগ পাইনি। একটি মাত্র গল্প দিয়ে সমগ্র গল্পকার সত্তার বিচার কখনোই করা যায় না। আমার উদ্দেশ্যও তা নয়। উপন্যাসের পাশাপাশি নোমানদার আরও অনেক ভালো ছোটগল্পের প্রত্যাশায় রইলাম।
রাজু বিশ্বাস
কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments