নুরা পাগলা
আরমানউজ্জামান
ছেলেবেলায় এক পাগলকে চিনতাম; নাম নুরা পাগলা। তার বাবা-মা অন্য কোনো নাম রেখেছিল কিনা জানি না। পরিবারে কেউ ছিল না তার। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ সে একদিন এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেল। গ্রামের লোকেরাও কেউ তার কোনো খোঁজ করে নি কখনো।
দীর্ঘ একযুগ পর সে আবার গ্রামে ফিরে আসল। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, মুখভর্তি দাড়ি আর লম্বা লিকলিকে শরীর। সে কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলত না। কেউ কিছু জানতে চাইলে তার ইচ্ছে হলে সীমিত কথায় উত্তর দিত; ইচ্ছে না হলে না হলে বরাবরের মতোই চুপ থাকত। এতদিন কোথায় ছিল, কী করত এসবের কিছুই সে বলতে পারতো না অথবা বলতো না।
বাচ্চারা খেলার ছলে কখনো তাকে পাগল পাগল বলে চিৎকার করলেও সে কিছু বলত না। কখনো ঢিল ছুঁড়ে তাকে রক্তাক্ত করলেও ক্ষেপে যেত না সে। তার কোন অভাব অভিযোগ কিছুই ছিল না। সে শুধু রাত দিন হাঁটত আর হাঁটত। রাত নেই দিন নেই গ্রামের সুরু আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত খালি পায়ে খালি গায়ে হেঁটে চলছে সে। তার হাঁটা দেখে মনে হতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ছুটে চলছে সে।
গ্রামের ঝোপঝাড়ের মধ্যে ভাঙাচোরা পৈত্রিক একটি বাড়ি তার। রাত হলেই যেখানে শোনা যেত বাদুরের পাখা ঝাপটানোর শব্দ আর শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল তাকে কেউ কখনো কিছু খেতে দেখে নি। কোনো কিছু না খেয়েই জীবন যাপন করত নুরা পাগলা এটা কেনো যেন এলাকার সবাই স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল। যদিও এ নিয়ে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।
আমিও দূর থেকে অনুসরণ করতে চেষ্টা করলাম তাকে। কী খেয়ে বাঁচে নুরা পাগলা। কিন্তু খুব একটা লাভ হয় নি। প্রায় এক মাস তার লিকলিকে শরীরের সাথে হেঁটে আমি ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত। সেই সাথে অন্যদের মতো বিশ্বাস করতে শুরু করলাম নুরা পাগলা কিছু না খেয়ে বেঁচে থাকে।
তার অনেক দিন পরের ঘটনা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল আমার। প্রচন্ড গরম, গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ যায় নি। চুপ করে দরজা খুলে বের হলাম বাড়ির সামনে নদীর ঘাটের উদ্দেশ্যে। গগন ভাসানো জ্যোৎস্নায় পৃথিবী জ্বলজ্বল করছে। নদীর বুকে চাঁদ অদ্ভুত মায়াবী লাগছে। আমি ছাতিম গাছের গোড়ায় বসে ঝিম ধরে ঘুমাতে চেষ্টা করছি। শিরশির ঠান্ডা বাতাসে আমার প্রাণ জুড়িয়ে ঘুম আসছে।
হঠাৎ ঠুনকো শব্দে চোখ মেলে তাকাতেই দেখি নুরা পাগলা। নদী পাড়ে পানি থেকে কিছু একটা তুলে গোগ্রাসে গিলছে। আমি চুপিচুপি তার পিছনে চলে গেলাম। মনে হল সে কোন মৃত পশুর নাড়িভুঁড়ি খাচ্ছে।
আমাকে দেখে চমকে উঠে বলল, খাবি?
আমি এই প্রথম নুরা পাগলার কণ্ঠ শুনলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার হাতে নাড়িভুঁড়ির মতো কিছু একটা তুলে দিল। আমার শরীর গুলিয়ে বমি আসতে লাগলো।
আমি হাত থেকে সেসব ছুড়ে ফেললাম নদীর মাঝে। সঙ্গে সঙ্গেই অনুভূত হল অসম্ভব সুন্দর ঘ্রাণ। আমি বিমোহিত হলাম যেন বেহেশতের সুবাসে। নুরা পাগলা ঠাঁই হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।মুহূর্তেই দেখলাম ঝকঝকে একটি কাসার প্লেটে গিয়ে পরলো অদ্ভুত সেই খাবারগুলো। সুগন্ধ দ্বিগুন বেড়ে গেল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাঁসার প্লেটটি ভেসে চলল নদীর মাঝে দিয়ে দূরে কোথাও এবং দ্রুতই সেটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।
নুরা পাগলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। এই প্রথম দেখলাম অসম্ভব সুন্দর ঝকঝকে সুবিন্যাস্ত পরিপাটি দাঁত তার। আমি জানতে চাইলাম আপনি আসলে কে? সে আবার হাসল।আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম নদীর ঘাটে। ভোরে জেলেরা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। আমার কাছে সকলেই জানতে চায় কী হয়েছিল নদীর তীরে! এত রাত্রে কেনো গিয়েছি সেখানে? আমি কাউকে কিছু বলতে পারি না শুধু রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হাঁটি আর সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজি একজন নুরা পাগলাকে।
গল্পঃ নুরা পাগলা।