বহু দিন পর বাড়ি যাব
স্বকৃত নোমান
বহু দিন পর বাড়ি যাব। যাওয়ার আগে মনে পড়ছে একটি সাপের কথা। ভুলে গিয়েছিলাম তার কথা। দুপুরে ভাতঘুমের আগে স্মৃতির স্তূপ সরিয়ে সে উঁকি দিল। ভয়ংকর বিষধর গোখরো। গোখরোকে আমরা বলতাম ‘হানক’। সে থাকত বাড়ির ঘাটায়। ওটাই ছিল তার সাম্রাজ্য। ঘাটা মানে তো আর এটুকু জায়গা নয়। উত্তরে বাঁশঝাড়, পুবে রেলরাস্তা, দক্ষিণে আর পশ্চিমে পুকুর―এই বিশাল জায়গা নিয়ে ঘাটা। পাথুরে মাটি। কে জানে কোথা থেকে এসেছিল ওসব খুদে পাথরেরা। হয়ত একদা পাথুরে পাহাড় ছিল সেখানে। পাহাড় কাটতে কাটতে সমান করে দিয়েছে মানুষেরা। মানুষ তো এমনই, নিজের সুবিধার জন্য সব বিনাশ করে দেয়।
সেই ঘাটায় চরে বেড়াত সাপটি। বেশ লম্বা। হয়ত খুব বেশি লম্বা ছিল না। সেই সময়টা তো আমাদের বিস্ময়ের কাল। আমাদের কল্পনার বাইরে যা কিছুই দেখতাম সবই বিশাল, সবই বিরাট, সবই লম্বা, সবই বিস্ময়। এখন দেখলে হয়ত সাপটিকে বিশাল মনে হবে না। কখনো খাঁখাঁ দুপুরে, আমরা যখন গ্রামের দিঘি থেকে গোসল করে বাড়ি ফিরতাম, তাকে দেখতে পেতাম। শাঁই করে চলে যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে কিংবা দক্ষিণ থেকে উত্তরে। কখনো সন্ধ্যায়, হারিকেন হাতে যখন আমরা বাড়ি ফিরতাম, হঠাৎ সে সামনে পড়ে যেত। ফণা তুলত না। তুলত না, কারণ সে জানত আমরা তাকে মারব না। মারার মতো কোনো অস্ত্র নেই আমাদের হাতে। চলার গতি বাড়িয়ে টুপ করে ঢুকে পড়ত পুকুরের ধারে রাস্তার কোনো গর্তে।
আবার কখনো তাকে দেখা যেত ঘাটার বাঁশঝাড়ে। কোনো একটা বাঁশে নিজেকে পেঁচিয়ে বংশীধারী কানাইয়ের মতো বসে আছে। কিংবা বসে নেই, খাবার শিকারে ওঁৎ পেতে আছে। কোনো ফড়িং, কি প্রজাপতি, কি পোকামাকড়ের জন্য অপেক্ষা করছে। সাপেরা কি পোকামাকড় খায়? হয়ত খায়। নইলে সে ওভাবে ওঁৎ পেতে থাকত কেন? আমাদের প্রবল ইচ্ছা জাগত একটা লাঠি নিয়ে তার মাথা বরাবর জোরসে বাড়ি দিই। যেন সে আমাদের আজন্মের শত্রু, তাকে মেরে ফেলাটাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য। কিন্তু শ্বাপদসঙ্কুল বাঁশঝাড়ে কে ঢুকবে! তার মতো আরো সাপ যে ওই ঝাড়ে ওঁৎ পেতে নেই, তা কে বলবে! তবু আমরা সাহসে ভর করে একটা লাঠি নিয়ে পা বাড়াতাম। সে বুঝি টের পেত। টের পেয়ে অমনি বাঁশ থেকে নেমে টুপ করে ঢুকে পড়ত পশ্চিমের পুকুরতীরের কোনো গর্তে।
আবার কখনো তাকে দেখা যেত আমাদের আনারস বনে। আহা সেই ভীতিপ্রদ আনারস বন! মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম কোনো অরণ্য, যার শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই; যে বনে একবার ঢুকলে আর কোনোদিন বের হওয়া যাবে না। দূরন্ত বালকের মতো সাপটি আনারস মুড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছুটে চলেছে। তাকে দেখে আমরা বিহ্বল। লাঠি খোঁজার কথা ভুলে যাই। যখন লাঠির কথা মনে পড়ে তখন তাকে আর দেখা যায় না। গহীন অরণ্যে সে লাপাত্তা। আমরা তবু তার অপেক্ষায় লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করতে করতে আমাদের ভুখ লেগে যেত, কিন্তু তার দেখা পেতাম না। যেন সে চিরকালের জন্য গহীন অরণ্যে হারিয়ে গেছে। আর কখনো ফিরবে না।
একদিন, এক ঘোর বর্ষার রাতে, আমরা যখন ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ কি ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ দেখে বাড়ি ফিরছি, যখন আমরা সিন্দাবাদের ভূতের ভয়ে কাবু, কিংবা টিপু সুলতানের তরবারির ঝলকে উদ্দীপ্ত, হঠাৎ দেখি সে রাস্তার ওপর ফণা তুলে বসে আছে। বসে আছে, না দাঁড়িয়ে আছে? হয়ত এভাবে ফণা তোলাটাকেই দাঁড়িয়ে থাকা বলে। সাপেরা বুুঝি এভাবেই দাঁড়ায়? আমাদের টর্চের আলো সরে না, স্থির হয়ে থাকে তার ফণার দিকে। আবারও আমরা লাঠির কথা ভুলে যাই, আবারও আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমরা ভুলে যাই সুইচটা টিপে টর্চের আলোটা নেভানোর কথা। নেভালে সে চলে যাবে। কিন্তু চলে যে যাবে তার কী নিশ্চয়তা? অন্ধকারে যদি ছুটে এসে আমাদের পায়ে দংশন করে বসে! আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। বিহ্বল দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের বুকের ভেতরে চলে রাতের ট্রেন। ধক ধক…ধক ধক…ধক ধক…। হঠাৎ আমরা পেছনে ছুট দিই। ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে আমরা চলে যাই বাড়ির পশ্চিমে। পেছনপথে আমরা ঢুকে পড়ি বাড়িতে।
কখনো গভীর রাতে, যখন বাতাস লেগে গাছের পাতারা অবিরাম হিসহিস হিসহিস ধ্বনি তুলত, আমাদের মনে হতো এই বুঝি সে এলো। দরজার বাইরে পৈঠায় ফণা তুলে সে বুঝি হিসহিস করছে! আমরা প্রচণ্ড গরমেও কাঁথাটা টেনে দিই গায়ের ওপর। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে যদি সে ফাঁকফোঁকড় গলিয়ে ভেতরে ঢুকে আমাদের দংশন করে! বিষদাঁত বসিয়ে দিলে আমরা তো আর ঘুম থেকে জাগব না, চলে যাব জীবনের ওপারে। কাঁথা গায়ে থাকলে তো পারবে না। কাঁথার ভেতর ঘামতে ঘামতে কেটে যেত গোটা রাত। কখনো প্রচণ্ড গরমে ভেঙে যেত ঘুম। শুনতে পেতাম না হিসহিস ধ্বনি। তখন ভুলে যেতাম সাপটির কথা।
কখনো মাঝরাতে কি শেষ রাতে আমরা শুনতে পেতাম খোঁয়াড়ে মুরগির ডাক, ছানাদের ছিঁ ছিঁ। কেন তারা এভাবে ডাকছে? কেন আবার, নিশ্চয়ই সেই ‘হানক’ হানা দিয়েছে। খোঁয়াড়ের ফোঁকড় দিয়ে ঢুকে কোনো মুরগিছানাকে হয়ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হয়ত সাপটি নয়, কোনো শেয়াল, কোনো বাঘডাঁশ কিংবা কোনো বিড়াল হানা দিত খোঁয়াড়ে। কিন্তু আমাদের মনে হতো কেবলই সাপটির কথা। সে-ই একমাত্র অপরাধী। এই বিশাল বাড়িতে যত অঘটন ঘটে সবই সে ঘটায়।
কোনো কোনো সকালে শুনতে পেতাম, বড়রা বলাবলি করছে, রাতে দুধরাজ এসে খেয়ে গেছে গাইগরুটির দুধ। চুষে চুষে ওলানটা শূন্য করে দিয়েছে। আচ্ছা, দুধরাজ নামে কোনো সাপ কি আছে? থাকলেও সে কি গাভীর ওলানের দুধ খায়? হয়ত আছে, হয়ত সত্যি খায়। এমনও হতে পারে দুধরাজ একটি মিথের সাপ, বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমাদের মনে হতো সেই গোখরোটিই দুধরাজ। সে-ই খেয়ে গেছে আমাদের কালো গাইটির দুধ। আমরা কল্পনা করতাম তার ওলানচোষা। যেভাবে আমরা মায়েদের স্তুন চুষতাম, ঠিক সেভাবেই বুঝি সাপটি গাভীর ওলান চুষে দুধ খেয়ে গেছে।
হঠাৎ একদিন আমরা আবিষ্কার করি, বহু দিন আমরা গোখরোটিকে দেখি না। কোথায় গেল? দূরের কোনো জঙ্গলে স্বজনদের কাছে বেড়াতে গেল, না মরে গেল? আমরা তার অপেক্ষায় থাকি। এবার দেখলেই আমরা তাকে মেরে ফেলব। কিন্তু সে ফেরে না। আমাদের অপেক্ষা ফুরায় না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একদিন আমরা অপেক্ষার কথাও ভুলে যাই। আর তখন একদিন দেখতে পাই বাড়ির ঘাটায় একটা শঙ্খিনী। দুই মাথার সাপ। আমরা আবার থমকে দাঁড়াই। আমরা আবার কাঁপতে থাকি, আমাদের বুকের ভেতর আবার চলতে থাকে ট্রেন। কিন্তু শিঙ্খিনী ফণা তোলে না। প্রবীণ মানুষের মতো ধীর পায়ে, রেলগাড়ির মতো হেলেদুলে সে আমাদের জন্য রাস্তা ছেড়ে দেয়।
আমরা তাকে প্রতিদিন দেখি, যেভাবে দেখতাম সেই গোখরোটিকে। আমরা একদিন লাঠিসোটা নিয়ে সাপটিকে মারতে রওনা হই। পৈঠায় বসা দাদি ডাক দিয়ে বললেন, ওই সাপ মারতে নেই, ওটা বাস্তুসাপ। আমরা তার বয়সী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি কীভাবে জানলেন ওটা যে শঙ্খিনী, ওটা যে বাস্তুসাপ? ভাবি, তবে কি এই বাস্তুসাপের ভয়েই গোখরোটি পালিয়েছে? তার সাম্রাজ্য কি দখলে নিয়েছে এই শিঙ্খিনী?
বহুদিন পর বাড়ি যাব। মনে পড়েছে সেই গোখরোর কথা, সেই শিঙ্খিনীর কথা। ভেসে উঠেছে তাদের গায়ের রং, চলার ধরন, ফণার ভয়ংকর সৌন্দর্য। ভাবি, মানুষ কি একা বেড়ে ওঠে? না, মানুষ একা বেড়ে ওঠে না, উঠতে পারে না। আরো অনেক কিছু নিয়ে সে বেড়ে ওঠে। গাছ, পুকুর, সাপ, কেঁচো, বাদুড়, ঘুঘু, বাঘডাঁশ, গরু, ছাগল, কুকুর, শেয়াল….আরো কত কি। সবই তার বেড়ে ওঠার সঙ্গী। তারা মানুষেরই পড়শি। তাদের বাদ দিয়ে মানুষের চলে না, চলতে পারে না। বহু দিন পর বাড়ি যাব। সেই সাপেদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাব।
বহু দিন পর বাড়ি যাব
১৭.০৫.২০২১