বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা –
আবু জাফর সিদ্দিকী
প্রথম আলোর জৈষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে সচিবালয় থেকে শাহবাগ থানায় আনা হয়।
রাতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ-সচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ উসমানী বাদী এ মামলা দায়ের করেন। সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়া মোবাইল ফোনে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবি তোলা এবং আরও কিছু নথি লুকিয়ে রাখার অভিযোগ এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনিয়ম-দূর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করায় রোজিনা ইসলাম এমন আক্রোশের শিকার বলে ধারণা দেশের গণমাধ্যম কর্মীদের। সংবাদকর্মীদের ওপর নির্যাতন শুধু এখানেই শেষ নয়। ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। পরদিন ভোরে তাঁদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। সম্পর্কে তারা স্বামী-স্ত্রী। ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদঘাটন করা হবে। ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনির হত্যা রহস্য উদঘটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ৯ অক্টোবর ‘চমক দেওয়া’ সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরা হয়, কিন্তু ঘটনার রহস্য আর উন্মোচিত হয়নি।
কিছুদিন পরপর আদালত থেকে একটি খবর পাওয়া যায়, ওই খবরে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় কতবার পেছানো হলো, সেই তথ্য থাকে। সব তথ্যই মোটামুটি এক, শুধু সংখ্যার পরিবর্তন হয়। সর্বশেষ সংখ্যাটি ছিল ৭৯, অর্থাৎ ৭৯ বারের মতো সময় নিয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ র্যাব। দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর ধরে চাঞ্চল্যকর একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় এভাবে পেছানোর নজির নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা হয় নানা কারণে, কিন্তু তদন্তের এই দীর্ঘসূত্রতা অনেকটাই নজিরবিহীন।
শফিকুল ইসলাম কাজল, একজন পেশাদার সাংবাদিক। নামকরা আলোকচিত্রী। তিনি রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রও করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে সরকার দলীয় একজন সাংসদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন। তিনি বাসার সামনে থেকে অপহৃত হন। সেই অপহরণের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছিল। পুলিশ অপহরণকারীদের খুঁজে বের করতে পারেনি।
অপহরণের দীর্ঘদিন পর হঠাৎ কাজলকে আবিষ্কার করা হয় বেনাপোল সীমান্তে। বেনাপোল থানা–পুলিশ তাঁর নামে একটি মামলা করে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া সীমান্তের এপারে আসার দায়ে। কিন্তু বিজিবি ও বিএসএফের সতর্ক ও সশস্ত্র পাহারা এড়িয়ে তিনি কীভাবে ওপারে গেলেন, সেই প্রশ্নের জবাব নেই। কারা তাঁকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে গিয়েছিলেন? কেন নিয়ে গিয়েছিলেন? ওপার থেকেই–বা কারা তাঁকে এপারে ঠেলে পাঠালেন? কাজল বলেছেন, ৫৩ দিন তাঁর চোখ বাঁধা ছিল। একজন চোখ বাঁধা মানুষের পক্ষে সীমান্ত পার হওয়া সম্ভব নয়।
শুধু সাগর-রুনি নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণ হারাতে হচ্ছে গণমাধ্যম কর্মীদের। আবার শুধু রোজিনা-কাজল নয়, দেশের আনাচে-কানাচে নির্যাতন, হামলা-মামলার শিকার হচ্ছে বহু সংবাদকর্মী। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। কিন্তু সাংবাদিক নির্যাতনের বিচার হয় না। ভয়ভীতি, হুমকি-ধামকি, মামলা-মোকদ্দমা, মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনে জখম থেকে শুরু করে গুম কিংবা খুন নির্যাতনের এমন কোনো ধরন নেই যার শিকার হচ্ছেন না সাংবাদিকরা। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর কিংবা মফস্বল সর্বত্রই চলছে এই নির্যাতন। স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বা সদস্য সবার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে তুলে নিয়ে নির্যাতন থেকে শুরু করে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে মারধরের শিকার হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। কিন্তু দেশে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা আর নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার নেই। হত্যা ও নির্যাতনের অগুনতি মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে, বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। বিচার না করায় দেশে এখন সাংবাদিক নির্যাতন নিত্যকার বিষয় হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নানারকম ভয়ভীতি-হুমকির কারণে সাংবাদিকতার পরিসর সংকুচিত হয়ে উঠছে, আরেক দিকে শারীরিকভাবে হামলা ও হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। এসব হামলা-নির্যাতন সাংবাদিকতা পেশাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এবং তথ্যপ্রকাশে বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে তা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাংবাদিক নেতারা অভিযোগ করে আসছেন, সাংবাদিক নির্যাতন ও সাংবাদিক হত্যার যথাযথ বিচার না হওয়া স্পষ্টতই অপরাধীদের দায়মুক্তি দিচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধে সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে সরকারকে। এভাবে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে হয়তো একসময় কেউ এ পেশাতে আর আসতে চাইবে না। খর্ব হবে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা। তাই এখনই সময় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকার ও সাংবাদিক নেতাদের ভাবার।
আবু জাফর সিদ্দিকী, নাটোর