প্রগতিশীলতা চর্চা করতে হয়, জারি রাখতে হয় – স্বকৃত নোমান
এক বন্ধু খুব আক্ষেপ করে বললেন, ‘দেখলেন সাম্প্রদায়িকরা কতটা ঐক্যবদ্ধ? তাদের কোনো নেতা ফেসবুকে পোস্ট দিলে হাজার হাজার লাইক-কমেন্ট। অথচ প্রগতিশীল কেউ কোনো পোস্ট দিলে আরেক প্রগতিশীল লাইক দেয় না, কমেন্ট করে না। কেন করে না জানেন? ঈর্ষা, বুঝলেন, ঈর্ষাবশত করে না। আবার দেখবেন এক লেখকের বই নিয়ে আরেক লেখক সহজে কথা বলতে চায় না। এটাও ঈর্ষা। কথা বললে লেখকটি যদি বিখ্যাত হয়ে যায়!’
বন্ধুকে বললাম, আমি এটাকে ঈর্ষা বলব না। আপনি যে সাম্প্রদায়িকদের ঐক্যের কথা বললেন, সেই ঐক্য স্বাভাবিক। কেন স্বাভাবিক জানেন? দুর্বলরা সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকে। কারণ তাদের পতনের ভয় আছে। সেজন্য তাদের সংগঠনেরও প্রয়োজন হয়। প্রান্তরে দেখবেন গরু-মেষরা পাল বেঁধে ঘাস খায়। ছাগল-ভেড়ারা দল বেঁধে চরে বেড়ায়। আর শেয়ালের দলকে দেখবেন, একটা হুক্কাহুয়া করে উঠলে বাকিরাও করে ওঠে।
কিন্তু বাঘ-সিংহ? বাঘ দল বেঁধে চলে না। সিংহও না। তারা বিচ্ছিন্নই থাকে। তাদের ঐক্যের দরকার হয় না। একটা গর্জে উঠলে আরেকটা গর্জে না। কারণ তারা তাদের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাদের পতনের ভয় নাই। তারা বিচ্ছিন্ন, তবু তাদের ভয়ে বনের অন্য পশুরা তটস্থ থাকে।
সুতরাং প্রগতিশীলদের, বা কবি-সাহিত্যিকদের এই বিচ্ছিন্নতা দোষণীয় বলে মনে করি না। এই অনৈক্য বরং বৈচিত্র। আর বৈচিত্রই সৌন্দর্য। সমুদ্রমোহনায় দেখবেন বিস্তর নান্দনিক দ্বীপ। প্রতিটি দ্বীপ কিন্তু বিচ্ছিন্ন। পাহাড়-পর্বতগুলো দেখবেন প্রতিটা বিচ্ছিন্ন। বিচ্ছিন্ন না হলে নান্দনিকতা থাকত না। সুতরাং প্রগতিশীল হওয়ার জন্য কোনো সংঘের প্রয়োজন নাই, সংগঠনের প্রয়োজন নাই, ঐক্যবদ্ধতার প্রয়োজন নাই। কেননা ‘মানুষ মাত্রই প্রগতিশীল।’ কথাটি কার? সম্ভবত সাদাত হাসান মান্টোর। মানুষের ইতিহাস প্রগতিশীলতার ইতিহাস। আজকে যারা ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, সংকীর্ণমনা, একদিন তারাও প্রগতিশীলতার তরীতে উঠবে। সংকীর্ণতা ঝেড়ে উদারবাদী হয়ে উঠবে। কেননা সময় কখনো পেছনে হাঁটে না, সবসময় সামনে হাঁটে।
কিন্তু একটা কথা আছে। প্রগতিশীলতা চর্চা করতে হয়, জারি রাখতে হয়। দেশ ও জাতির যে কোনো সংকটে মাঝেমধ্যে প্রগতিশীলদের ঐক্যের প্রয়োজন হয়। তখন বুদ্ধের বাণী ‘সংঘং শরণং গচ্ছামি’কে গুরুত্ব দিতে হয়। নইলে সংকট ভয়াবহ আকার ধারন করে। এখন তো প্রযুক্তির কাল। ফেসবুক জামানা। দেশ ও জাতির যে কোনো সংকটে ফেসবুকে কারা কথা বলে? অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কারা প্রতিবাদ করে? প্রগতিশীলরাই করে। সাম্প্রদায়িকরা করে না। তারা কেবল একটা নিয়েই আছে : ‘জাত গেল জাত গেল! ধর্মের নাশ হলো, সর্বনাশ হলো!’ এছাড়া তারা আর কিছু জানেও না, বোঝেও না। তারা প্রতিবাদ করবে কী? যেসব প্রগতিশীল প্রতিবাদ জারি রাখেন তাঁরাও বুদ্ধিজীবী। এই বুদ্ধিজীবীতার খুব প্রয়োজন। এরাই জাতিকে দিশা প্রদান করে চলেছেন। কখনো কখনো রাজনীতিকেও দিশা দিয়ে থাকেন। তাঁদেরকে প্রণাম।
মহাকালে রেখাপাত
১০ মে ২০২১